শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেজাজ হারাচ্ছেন মানুষ

মেজাজ হারাচ্ছেন মানুষ

টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। পরিস্থিতির বাইরে নয় বাংলাদেশ। হঠাৎ বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সবখানে। বেড়েছে সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। নিত্যপণ্যের দামও আকাশ ছোঁয়া। সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়। কমেছে প্রবাসী আয়। দেখা দিয়েছে ডলার সংকট। ফলে কমছে টাকার মান। চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। এসবের প্রভাবে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে মেজাজ হারাচ্ছে মানুষ।

পল্টন থেকে বাংলামটরের পথে যাত্রা। পুরনো নিয়মেই চলছিলো যাত্রী উঠানামা। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ। পিছন ফিরে দেখি এক ভদ্রলোক ধমকের পর ধমক দিচ্ছেন এক যুবককে। যুবকও পাল্টা জবাব দিচ্ছেন। সবাই যুবকটিকে থামানোর চেষ্টা করছেন। অন্য যাত্রীদের অনুরোধে শান্ত হলেন যুবক। তার চোখ তখন রক্তবর্ণ। তবুও অনর্গল ধমক দিয়েই যাচ্ছেন সেই ভদ্রলোক।

কী হয়েছে? জানতে চাইলে বাসের অন্য যাত্রীরা বলেন, ভাই বুঝেনই তো। মুরব্বির মাথা খুব গরম আছে। মুরব্বিকে কী হয়েছে জানতে চাইলে সমস্বরে অন্যান্য যাত্রী বলেন, যেভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে কার মাথা আর ঠিক আছে। কোনো কথা নাই, কিছু নাই হুট করে রাতের অন্ধকারে তেলের দাম বাড়িয়ে দিলো। বাস মালিকরাও ভাড়া বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু আমাদের তো বেতন বাড়ছে না। বরং চাকরি নিয়ে শঙ্কায় আছি। বেতন বাড়ানোর কথা কি বলবো, চাকরি হারানোর ভয়েই তো আতংকে থাকতে হয়।

পরে জানা গেলো ভদ্রলোকের নাম মতিন মিয়া। বয়স ৫০ বছর। থাকেন বাংলামটর এলাকায়। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীসহ ৫ জনের সংসার। দুই মেয়ে পড়াশোনা করছে রাজধানীর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ছেলে পড়ছে উচ্চ মাধ্যমিকে। মতিন মিয়া মাস শেষে বেতন পান ৩০ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া দিতেই খরচ হয়ে যায় ১৫ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি এবং সার্ভিস চার্জ বাবদ দিতে হয় আরো ৪ হাজার টাকা। যাতায়াত খরচ মাসে এক হাজার টাকা। বাকি টাকায় চলে খাবার, জামা-কাপড়, ছেলে-মেয়ের পড়াশুনা এবং চিকিৎসা। এ টাকায় একজন মানুষের সংসার চলার কথা না। তবুও চালিয়ে নিচ্ছেন এই ভদ্রলোক।

আরও পড়ুনঃ  আমনের বাম্পার ফলন, ন্যায্য দামের শঙ্কায় কৃষক

গত সোমবার রাতে মতিন মিয়া বলেন, সকালে বাজারে গিয়েই মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। সব ধরণের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। অর্ধেক বাজার করেই ফিরে এসেছি। যেটাই কিনতে যাই দাম চায় প্রায় দেড় গুণ। কাঁচামরিচের দাম চায় ২৫০ টাকা। কমের মধ্যে আছে শুধু পাঙ্গাস মাছ। তাও ১৬০ টাকার নিচে না। বাজার শেষে বাসায় গিয়েছিলাম। বউ বললো এতো কম বাজার কেন? দিয়েছি তাকে একটা ধমক। যদিও আগে কখনও এমন ধমক দিইনি। ধমক শুনে সেও চুপসে গেছে। পরে সারাদিন অফিস করেছি। এখন বাসায় যাচ্ছি। বিআরটিসি বাসে আগে মতিঝিল যেতাম ১০ টাকায়। এখন দিতে হয় ১৫ টাকা। অন্য বাসগুলো বাড়তি ভাড়াও নিচ্ছে। যে যেভাবে পারছে আদায় করে নিচ্ছে। দাঁড়িয়ে যাচ্ছি তবুও ভাড়া সমান সমান। একজনের ওপর ১০ জন। এখন এমনিতেই কারো কথা ভালো লাগে না। দ্রব্যমূল্যের এমন উর্ধগতিতে খুব বেশি চিন্তায় আছি।

উবার চালক মনিরুল ইসলাম। গতকাল মঙ্গলবার তার কাছে জানতে চাওয়া হয় কেমন আছেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন তিনি। বলেন, বলার কী আছে আপনি নিজেই তো জানেন। রাগ করছেন কেন? এমন প্রশ্নে তার জবাবে বলেন, রাগ করবো না কি আদর করবো?

পরে অবশ্য শান্ত হয়ে মনিরুল বলেন, ভাই রাগ করবেন না। সকাল থেকে ঘুরছি, কিন্তু যাত্রী পাচ্ছি না। আগে দুপুরের মধ্যেই আয় করতাম ৪০০-৫০০ টাকা। আর এখন বিকেল হয়ে গেছে মাত্র ২০০ টাকা আয় করেছি। সকালে নাশতা খেতে চলে গেছে ৫০ টাকা। এখন একটা কলার দামই ১৫ টাকা। ১৫ টাকার নিচে পাউরুটিও পাওয়া যায় না। এক কাপ চা-ও এখন ১৫ টাকা। দুপুরের খাবারে চলে গেছে ১২০ টাকা। সব মিলিয়ে ১৭০ টাকা এখানেই শেষ। কী করবো বলেন? বাড়ি থেকে কল দিয়েছিলো। তাদের কোনো কথাই আমার কাছে ভালো লাগছিলো না। রাগারাগি করে ফোন কেটে দিয়েছি। দুদিন ধরে ঝগড়ার ওপরেই আছি। রুমমেটের সাথেও ঝগড়া হয়েছে। পরে অবশ্য আবার মিলে গেছি।

আরও পড়ুনঃ  পটুয়াখালীতে তথ্য অধিকার আইন বিষয়ক জনঅবহিতকরণ সভা

এই উবার চালক বলেন, আমি আগে চাকরি করতাম। এখন উবার চালাচ্ছি। তেলের দাম বেড়েছে, সে অনুযায়ী বাড়তি ভাড়া পাচ্ছি না। বাড়তি ভাড়া চাইলে যাত্রীরা বলে, আমাদের তো বেতন বাড়েনি, কই থেকে বাড়তি ভাড়া দিবো? এটা গেলে আর কিছুই করার থাকবে না। আগে যেখানে লাভ হতো ১০ টাকা এখন হয় ২ টাকা। সরকার তার মতোই চলছে, আমাদের কথা কানেই তোলে না। জনগণের কষ্টে মন্ত্রীদের কষ্ট পাওয়া উচিতৎ। এটাই তো দেশ।

মানুষের মেজাজ হারানো বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজা খানম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আব্রাহাম মাসলোর একটি থিউরি আছে। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন সবার আগে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে। এরপর অন্যান্য বিষয়। যখন মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হবে তখন মানুষ ভালো থাকবে। কিন্তু এখন মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য লাগাম ছাড়া। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় হচ্ছে না। বাজারে গেলে মানুষ মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। আর এটাই হওয়ার কথা। কারণ যখন নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে না পারবে তখন মানুষের মনের মধ্যে একটা প্রভাব পড়ে। এতে মানসিকভাবে চাপ সৃষ্টি হয়। যে কারণে খুব দ্রুতই মানুষ মেজাজ হারাচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন