শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
তিস্তা পাড়ে কান্নার রোল

ভাঙছে বাড়ি কাঁদছে মানুষ

ভাঙছে বাড়ি কাঁদছে মানুষ

তিস্তার কয়েক দফা বন্যা ও নদীর ভাঙনে সংকুচিত হচ্ছে সীমান্তবর্তী লালমনিহাটের পাঁচ উপজেলা। তিস্তার অব্যাহত ভাঙনে দিন দিন নদীর গর্ভে বসতভিটা, মসজিদ-মন্দির, স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থাপনা। তিস্তার ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের পরিবারগুলো।

গত তিন দিনপূর্বে থেকে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে লালমনিরহাটে আদিতমারী উপজেলার কয়েকটি গ্রামে দেখা দিয়েছে ভয়াভয় ভাঙন। তিস্তার ভাঙনে রক্ষা পায়নি বাড়ি ভিটে, গাছ পালা ফসলিজমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

প্রতিবছর তিস্তা নদী বালু দিয়ে ভরাট হওয়ার কারণে নদী গতিপথ পাল্টে নতুন নতুন এলাকা ভাঙনের মুখে পড়ছে। স্থানীয়দের দাবি রিলিজ স্লিপ চাইনা তিস্তা নদীর স্থায়ী বাঁধ চাই। গতকাল সোমবার বিকেলে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা দোয়ানিতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজের পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ভাঙন। তিস্তার ভয়াবহ ভাঙনে অসংখ্য পরিবার বিভিন্ন বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এদিকে লালমনিরহাট সদর উপজেলায় ভাঙনের মুখে পড়েছে চোংগাডারা উচ্চ বিদ্যালয়, খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন পরিষদ, ভূমি অফিস, খুনিয়াগাছ উচ্চ বিদ্যালয়সহ নানা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। নদীর কিনারায় পড়েছে নির্মাণাধীন চোংগাডারা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪তলা বিশিষ্ট ভবনসহ শতাধিক বসতবাড়িও।

উপজেলার পূর্ব কালমাটি গ্রামের মিনু বেওয়া বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার ১২ বছর অনেক কষ্টের সন্তানদের মানুষ করেছি। তিস্তা নদী ভাঙতে ভাঙতে বাড়ির কাছে চলে এসেছে কবে যে বাড়িটি ভেঙে নিয়ে যায় সে দুশ্চিন্তায় রাত কাটাচ্ছে। কালমাটি গ্রামটি অনেক বড় ছিল আস্তে আস্তে সবাই ভিটেমাটি হারিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ি করে আছেন।

আরও পড়ুনঃ  মিয়ানমারে ফের গোলাগুলি আতঙ্কিত সীমান্তের বাসিন্দারা

স্থানীয়রা জানান, গত ১ আগস্ট ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ মিটার ৮৫ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যা (স্বাভাবিক ৫২ মিটার ৬০ সেন্টিমিটার)। এর পরের দিন পানি কমে ফের বিপৎসীমার উপরে উঠে তিস্তার পানি। এতে ৪৪টি গেট খুলে দেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন।

জানা যায়, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা নদী।

যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশে যায়। দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত সরকার এক তরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় শীতের আগেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিস্তার বাম তীরের জেলা লালমনিরহাট।

তিস্তা নদী জন্মলগ্ন থেকে খনন না করায় পলি পড়ে ভরাট হয়েছে নদীর তলদেশ। ফলে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে বর্ষাকালে উজানের ঢেউয়ে লালমনিরহাটসহ ৫টি জেলায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এ সময় নদী ভাঙনও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রতি বছরই নদী পরিবর্তন করছে তার গতিপথ। ফলে লালমনিরহাটে বিস্তীর্ণ জমি বালুময় চরাঞ্চলে পরিণত হচ্ছে।

বর্ষায় ভয়াবহ বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ভাঙন আতঙ্কে পড়ে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা। গেল সপ্তাহে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই তীব্র ভাঙনের মুখে পড়ে নদীপাড়ের মানুষ। এক একটি পরিবার ৮ থেকে ১০ বার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সরিয়ে নিয়েছেন বসতভিটা। কেউ কেউ রাস্তার ধারে বা বাঁধের পাশে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তিস্তাপারের হাজেরা বেগম বলেন, নদীতে বসতবাড়ি হারিয়ে মানুষের জমিতে আশ্রয় নিয়ে আছি। সেখানেও তিস্তা হানা দিয়েছে এ্যালা কোথায় যামু মরণ ছাড়া কোনো উপায় নাই।

আরও পড়ুনঃ  সাভারে জনসমাগম এড়ানোর নির্দেশ মানছে না কেউ

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা  ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, চলতি বছর তিস্তাপাড়ের প্রায় ৩০টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। পরিবারগুলোকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিবছর তিস্তার নদীর ভাঙন দেখা দেয়।  তবে চলতি বছর কিছুটা ভাঙন কমেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙনরোধ করা হচ্ছে। 

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন