শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জেলেপল্লীতে হাহাকার

জেলেপল্লীতে হাহাকার
  • ইলিশের দেখা নেই

বঙ্গোপোসাগরের মিরসরাই অংশে ভরা মৌসুমেও দেখা মিলছেনা পর্যাপ্ত ইলিশের। সারাদিন বোট নিয়ে সাগরে জাল ফেলে সন্ধ্যায় জেলেরা ফিরছে খালি হাতে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর ইলিশের এ ভরা মৌসুমেও পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে উপজেলার ২৯ জেলেপাড়ার ৫ হাজার জেলে পরিবার।

সারা দেশের বিভিন্ন ইলিশ ধরার পয়েন্টে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়লেও মিরসরাইয়ের ভিন্ন চিত্র প্রভাব ফেলেছে স্থানীয় জেলেদের জীবন ও জীবিকায়। প্রতিদিনই একবুক আশা নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে বের হচ্ছেন জেলেরা। কিন্তু বিধি বাম। আশা রূপ নেয় হতাশায়। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার বোট খরচ ও মজুরীর তুলনায় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছেনা সন্তোষজনক হারে।

এদিকে ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে উপজেলার অধিকাংশ জেলে পরিবার। অমৌসুমে ঋণ নিয়ে ও ধারদেনা করে বোট ও ইলিশ ধরার জাল সংস্কার করেন জেলেরা। সেসময় সংসারও চলে ধার-দেনার টাকায়। তাদের ভরসা ছিলো মৌসুমের ইলিশ। ভরা মৌসুমে তারা ইলিশ ধরে লাভবান হলে ধার-দেনা পরিশোধ করার আশা থাকলেও তাতে হয়েছে গুড়ে-বালি।

জেলেরা জানায়, বর্তমানে তারা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে পর্যাপ্ত ইলিশ পাচ্ছেনা । বোটে যে তেল লাগে তার পুরোটাই লোকসান। তার উপর আছে শ্রমিকের মজুরী। সংসার চালানোই দায় পড়েছে তাদের। এদিকে মহাজন ও এনজিওরা ঋণের টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। সবমিলে নাজেহাল অবস্থার বর্ণনা দেয় স্থানীয় জেলেরা।

সরেজমিনে গিয়ে, উপজেলার ডোমখালী উপকূলে ক্রেতাদের প্রচুর ভিড় দেখা যায়। কিন্তু তখনো ফেরেনি ইলিশ ধরার বোটগুলো। একটু পরই শোনা যায় ইঞ্জিনের শব্দ। ক্রেতারাও মাছ ধরার জন্য উপকূলে এগুতে থাকে। কিন্তু একেরপর এক বোটগুলো ফিরছে খালি পাটাতনে। জেলেদের চোখে-মুখে রাজ্যের হতাশা। একইভাবে হতাশ দূর-দুরান্ত থেকে আসা ক্রেতারাও।

আরও পড়ুনঃ  দুই যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশিদের নিষিদ্ধ করলো ইতালি

লিটন দাশ নামের এক জেলে বলেন, সাগরে ইলিশ ধরা আমাদের পৌতৃক পেশা। ছোটবেলা থেকেই এ পয়েন্টে মাছ ধরছি। কখনোই এমন হতাশ হইনি। বছর দুয়েক আগেও এখানে আমরা প্রচুর ইলিশ পেয়েছি। মিরসরাইয়ের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আমরা চট্টগ্রাম ও ফেনী শহরেও মাছ পাঠাতাম।

ভরা মৌসুমে ইলিশের আকালের জন্য শিল্পয়নকে দায়ী করেন লিটন দাশ। তার অভিযোগ, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলায় ইলিশের বিচরণ এ অঞ্চলে কমে গেছে। তাছাড়া এখন প্রতিনিয়তই এ রুট ব্যবহার করে বিভিন্ন ছোট বড় জাহাজ আসছে। এটাও ইলিশ না পাওয়ার আরেকটি কারণ। অনেক সময় আমাদের জালও এসব জাহাজে কাটা পড়ে। তখন আমরা তীব্র ক্ষতির সমুখিন হই। ড্রেজিং এর মাধ্যমে বালু উত্তোলনের কারনেও মাছ কমে গেছে বলে যোগ করেন তিনি।

কথা হয় মাছ কিনতে এসে খালিহাতে ফেরত যাওয়া এক ব্যক্তির সাথে। মায়ানী দিঘির পাড়া এলাকার তৌহিদুল ইসলাম নামের এ ক্রেতা বলেন, ঘাট থেকে ইলিশ কেনায় একটা আলাদা আনন্দ আছে। বাইক নিয়ে মাছ কিনতে এ নিয়ে ৩ দিন এসেছি। কিন্তু আমি হতাশ। কিনে নিয়ে যাওয়ার মতো মাছ পাইনি।

জগন্নাথ জলদাশ, জয়গোপাল জলদাশ বলেন, এখানে ইলিশ ধরার ১৫০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা রয়েছে। আজও ৪০-৫০টি নৌকা মাছ ধরতে সাগরে গেছে। আগে সাগরে কাছে গেলেও মাছ পাওয়া যেত, এখন গভীর সাগরে গিয়েও মাছ পাচ্ছি না। সব নৌকা মিলিয়ে ৫ মণ মাছও পাওয়া যায়নি। সাগরে চায়নারা আমাদের জাল কেটে দেয়। অনেক সময় জাহাজের কারণে জাল কেটে যায়। ছোট একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা সাগরে গেলে নূন্যতম ৭শ টাকার জ¦ালানি তেল লাগে।

আরও পড়ুনঃ  চরফ্যাশনে মাস্ক না পড়ায় ২৪জনকে ভ্রাম্যমান আদালতের জরিমানা

উপকূলীয় জেলে সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিলাল জলদাশ বলেন, মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের বিভিন্ন পয়েন্টের সুইচ গেইটের দরজাগুলো খুলে দেয়ায় স্রোত বেড়ে গেছে সাগরের। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্মিতব্য বিভিন্ন কলকারখানার স্ক্র্যাপ বর্জ্য সাগরের পানি দূষিত করে ইলিশের প্রজনন ধ্বংস করে দিচ্ছে। সাগর থেকে ড্রেজিং’র মাধ্যমে বালু উত্তোলনও অন্যতম কারণ হতে পারে। তিনি আরো বলেন, এখন ভরা মৌসুম হলেও বঙ্গোপসাগরের মিরসরাই-সন্দ্বীপ চ্যানেলে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও আশা রাখছি আগামী পূূর্নিমার জোঁ-তে হয়ত এই আকালের কিছুটা অবসান হবে।

মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বলেন, ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা শেষে দেশের বিভিন্ন স্থানে জেলেরা প্রচুর পরিমাণ ইলিশ মাছ ধরছেন। অনেকটা নিষেধাজ্ঞার সুফল বলা যায়। কিন্তু মিরসরাইয়ের ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। এখানকার জেলেরা সাগরে গিয়ে ইলিশ পাচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, না পাওয়ার অন্যতম কারণ মাছ বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তন করেছে। এখানকার বর্তমান পরিবেশ মাছের বিচরণক্ষেত্রের উপর প্রভাব ফেলেছে। মাছ একবার তাঁর বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তন করলে সেখানে আর ফিরে আসে না। শিল্পনগর প্রতিষ্ঠা এর অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন