ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘ভারাক্রান্ত’ নয় জনসংখ্যা

ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২

জাতিসংঘের বিশ্ব জনসংখ্যা সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার মেট্রোপলিটন এলাকার জনসংখ্যা ২০২২ সালে ২ কোটি ২৪ লাখ ৭৮ হাজার। যা আগের বছরের তুলনায় ৩.৩৯ শতাংশ বেড়েছে। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি সমাপ্ত জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর সদ্য প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৯ লাখ ২১ হাজার ১০ জন।

ঢাকার জনসংখ্যা নিরূপণে জাতিসংঘ ও বিবিএসের তথ্যের ফারাক এক কোটি ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৯০। যা নিয়ে আলোচনা, তর্ক বিতর্ক চলছে। তবে এসব ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, দেশের জনসংখ্যা নিয়ে অনেকে নানা কথা বলেন। কেউ বলেন ১৮ কোটি, কেউ বলেন ২০ কোটি। তবে এসব কথা অনুমাননির্ভর। এখন থেকে আমরা বলবো, দেশের বর্তমান মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। এটিই আসল তথ্য।

গতকাল বুধবার নগরীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে স্পিকার এসব কথা বলেন।

ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আরও বলেন, আমরা জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন পেয়েছি। অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে কাজ সমাপ্ত হয়েছে। রিপোর্টও চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। জাতির পিতা সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালে বিবিএস প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের সব দেশেই জনশুমারি হয়। কাজটি খুবই জটিল ও সূক্ষ্মভাবে করতে হয়।

প্রকাশিত প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ৪ হাজার ৯১৯ জন। বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার দাঁড়িয়েছে ৭৪.৬৬ শতাংশ। বেড়েছে নারীর জন্মহারও। সেইসঙ্গে ৫ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার করছে ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আর ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীর সংখ্যা ৩৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিবিএস এর তথ্য ও পরিসংখ্যান বিভাগ গত ১৩-২১ জুনের ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা পরিচালনা করে গতকাল প্রতিবেদনটি তুলে ধরে। বিআইসিসিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে মূল প্রতিবেদন তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালন মো. দিলদার হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হেসেন, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ও প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব আহমদ কায়কাউস। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিসংখ্যান সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. মতিার রহমান।

এ শুমারিতে প্রাথমিকভাবে গণনার আওতায় আসে ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৪ হাজার ৬১৬ জন। যা ২০১১ সালের আদম শুমারিতে জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭ জন। সে হিসেবে জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ৪ হাজার ৯১৯ জন।

ষষ্ঠ শুমারিতে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে দেশে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন। নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। সে হিসেবে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি ১৬ লাখ ৩৪ হাজার ৩৮২ জন। হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন।

তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে এ শুমারিতে প্রতিবন্ধী বৃদ্ধির সংখ্যাটিও বেড়েছে। ২০১১ সালে প্রতিবন্ধী ছিল ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ সেখানে ষষ্ঠ জনশুমারির হিসেবে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী বেড়েছে দশমিক ২ শতাংশ। মোটি প্রতিবন্ধী ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৪ জন।

পল্লি অঞ্চলে জনসংখ্যা ১১ কোটি ৩০ লাখ হাজার ৫৮৭ জন। পুরুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৫১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৪২ ও নারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৯০ হাজার ৪৬২ জন ও হিজড়া ৬ হাজার ২৮৩ জন। শহুরে মোট জনসংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখ ৯ হাজার ৭২ জন। এতে পুরুষের সংখ্যা ২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার ৯৮২ জন ও নারীর সংখ্যা ২ কোটি ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৪ জন ও হিজড়ার সংখ্যা ৬ হাজার ৩৪৬ জন।

স্বাধীন দেশে ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত লিঙ্গানুপাত ছিল ১০৮। এটি ১৯৮১-২০০১ সালে হ্রাস পেয়ে ১০৬ এ স্থির ছিল। ২০১১ সালে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১০০.৩ এবং ২০২২ সালে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৯৮.০৪। দেশে বর্তমানে ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষ আছে ৯৮ জন। ঢাকা বিভাগে লিঙ্গানুপাত সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১.৭৪ শতাংশ ও বরিশালে সবচেয়ে কম। সেখানে ০.৭৯ শতাংশ।

জনসংখ্যার বৃদ্ধি ক্রমান্নয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৮১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.৮৪ শতাংশ। বর্তমানে এটি ১.২২ শতাংশ। ১৯৯১ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ২.০১, ২০০১ সালে ১.৫৮ ও ২০১১ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ১.৪৬ শতাংশ। ১৯৯১ সাল হতে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩১ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে ১.৬২ শতাংশ।

বেড়েছে জনসংখ্যার ঘনত্ব: বর্তমানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব হচ্ছে ১১১৯ জন। অথচ ২০১১ সালে ছিল ৮৭৬ জন। আর ১৯৮১ সালে ছিল ৫৯০, ১৯৯১ সালে ৭২০, ২০০১ সালে ৮৪৩ জন ছিল। বর্তমানে ১০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী অবিবাহিত জনসংখ্যা ২৮.৬৫ শতাংশ ও বিবাহিতের সংখ্যা ৬৫.২৬ শতাংশ। সর্বোচ্চ বিবাহিত রাজশাহীতে অর্থাৎ ৬৮.৯৭ শতাংশ ও সর্বনিম্ন সিলেটে। সেখানে ৫৫.৫৯ শতাংশ।

ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ১৩-২১ জুন ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ইসলাম ধর্মালম্বী জনসংখ্যা ৯১.০৪ শতাংশ। হিন্দু ৭.৯৫, বৌদ্ধ ০.৬১, খ্রিস্টান ০.৩০ ও অন্যান্য ধর্মালম্বী ০.১২ শতাংশ। ২০১১ সালে ধর্মালম্বীদের মধ্যে যথাক্রমে ইসলাম ৯০.৩৯ শতাংশ, হিন্দু ৮.৫৪, বৌদ্ধ ০.৬২, খ্রিস্টান ০.৩১ ও অন্যান্য ধর্মালম্বী ০.১২ শতাংশ। এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১.০০ শতাংশ। তাদের মধ্যে পুরুষ ১.০১ ও নারী ০.৯৯ শতাংশ।

পল্লি অঞ্চলে শিশু-মহিলার অনুপাত ৩৫১ ও শহুরে ২৯৫ এবং জাতীয় পর্যায়ে ৩৩২। দেশে মোবাইল ব্যবহারে জাতীয়ভাবে ৫৫.৮৯ ও পুরুষ ৬৬.৫৩ এবং নারী ৪৫.৫৩ শতাংশ। আর ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকে জাতীয়ভাবে ৩০.৬৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে পুরুষ ৩৮.০২ ও নারী ২৩.৫২ শতাংশ। দেশে খানার সংখ্যা হচ্ছে ৪ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার ৫১ জন। সেখানে পল্লিতে ২ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ৩৪১ ও শহুরে ১ কোটি ৩১ লাখ ৮৯ হাজার ৭১০টি।

জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী ২০২১ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ ৪১ হাজার, যা ২০২০ সালে ছিল ২ কোটি ১০ লাখ ৬ হাজার। এ হিসেবে বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে শহরের মধ্যে রাজশাহীতে সবচেয়ে কম সেখানে জনসংখ্যা ২৪ লাখ ২১ হাজার ৯৪৯ জন।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ লাখ। ১৯৮১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ লাখ ২৩ হাজার ৮৮৩ জনে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১০ বছরে লোকসংখ্যা বাড়ে ২২ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৮ জন। এরপর ১৯৯১ সালে রাজধানীর লোকসংখ্যা দাঁড়ায় ৬৮ লাখ ১১ হাজার ৬৪২ জনে। ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ২৭ লাখ ৮৭ হাজার ৮০৪ জন, যা ১৯৮১ সালের থেকেও ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯৬৬ জন বেশি।

২০০১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ৮৩ লাখ ৭৮ হাজার ৫৯। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালে এসে লোকসংখ্যা বেড়েছে ১৫ লাখ ৬৬ হাজার ৪১৭ জন। হিসাব অনুযায়ী ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ সালের তুলনায় ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ১২ লাখ ২১ হাজার ৩৮৭ জন মানুষ কম বেড়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী নগরীর জনসংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ।

২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত লোকসংখ্যা বেড়েছে ৪৬ লাখ ২১ হাজার ৯৪১ জন। তবে বর্তমানে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা বর্তমানে এক কোটি ৭০ লাখ, যা ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে দুই কোটি ৭৪ লাখে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন