রাজধানীবাসীর যাতায়াতের দুর্ভোগ কমাতে এবং আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্প শেষে দেশের প্রথম উড়াল ট্রেনে কম সময়ে পৌঁছানো যাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। তবে উত্তরা থেকে কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ২২ কিলোমিটার পথে অসহনীয় যানজট থেকে মুক্তির অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছে। কাজ শেষ হতে আরও অন্তত দেড় বছর সময় লাগবে। একই সঙ্গে ব্যয় বাড়ছে ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ বা ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। অবশ্য আগামী ডিসেম্বরে দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আংশিক ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার আশা করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট (এমআরটি-৬) প্রকল্পে নির্মাণকাজের জন্য বাড়তি সময় ও অর্থ চেয়ে দ্বিতীয় দফা সংশোধনীর প্রস্তাব করে বাস্তবায়নকারী সংস্থা এমআরটি-৬। প্রস্তাবটি গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এতে সভাপতিত্ব করেন।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, প্রকল্পটির দৈর্ঘ্য বাড়বে ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার ধরে মেট্রোরেলের রুট দাঁড়াচ্ছে ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার। প্রকল্পের ১০টির বেশি অঙ্গে খরচ বাড়ছে। সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পের জন্য নেওয়া বিদেশি ঋণের সুদ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া পরামর্শক খাতেও ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৫৭৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যা আগে ছিল মাত্র ১৩৯ কোটি টাকা। ফলে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে শুরুতে মূল প্রকল্পে ব্যয় ধরা ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।
মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বাড়ায় খরচ বেড়েছে ৭২৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। মতিঝিল থেকে কমলাপুরের রোলিং স্টকসের (রেল কোচ) জন্য ব্যয় বাড়ছে ৩৬ কোটি টাকা। স্টেশন প্লাজার জন্য ব্যয় বাড়ছে ১৬৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কাস্টমস ডিউটি ও ভ্যাটের জন্য ব্যয় বাড়ছে ২ হাজার ২২৯ কোটি টাকা।
সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের ফলে প্রকল্পের মোট সময় লাগবে ১৩ বছর। ২০১২ সাল থেকে শুরু হয়ে আগামী ২০২৪ সালের জুনে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, কাজ শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকা এই প্রকল্পে মূল ঋণ জোগানদাতা। ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা দিচ্ছে সংস্থাটি। বাকি ১৩ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব জোগান।
মেট্রোরেল সরকারের একটি ফার্স্ট ট্র্যাক বা অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্প। বর্তমানে প্রকল্পটির সার্বিক গড় অগ্রগতি ৮১ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৯৪ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি প্রায় ৯০ শতাংশ। এ পর্যন্ত ১৮ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে।
একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তুলে ধরে বলেন, বড় বড় ল্যান্ডিং স্টেশনে পার্কিং স্পেস করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাছাড়া স্টেশনে অপেক্ষামাণ যাত্রী ও শিশুদের খেলার জন্য এমিউজমেন্ট পার্ক করার কথা বলা হয়। হাসপাতালের পাশ্ববর্তী এলাকায় মেট্রোরেলের জন্য সাইন্ড ব্রেকার রাখার কথাও বলেন তিনি।
প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, মতিঝিল থেকে নতুন করে কমলাপুর পর্যন্ত কাজ বাড়ছে। এখানে নতুন করে দামি জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে। তাই ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ছে। কমলাপরি থেকে যেন কষ্ট করে যাত্রীদের আবার মতিঝিলে আসতে না হয় সে জন্যই প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শনার আলোকে এ কাজ বর্ধিত করা হচ্ছে। প্রকল্পের জন্য জমি হারানো ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রয়োজনে স্বল্প খরচে ফ্ল্যাট করে দেয়া বিষয়টিও সামনে আনেন প্রধানমন্ত্রী।
একনেক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান বৈদ্যুৎ সংকটের মধ্যে মেট্রোরেল বিদ্যুতের মাধ্যমে পরিচালিত হলে তা কতটা ব্যয় সাশ্রয়ী হবে এমন প্রশ্ন করা হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলেও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী কৌশলী জবাব দেন। তিনি বলেন, অনেক সময় জনগণকে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যয়ের বিষয়টি মূখ্যভাবে চিন্তা করা হয় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, অনেক হাসপাতল লাভজনক নাও হতে পারে। তবে সেবা প্রদানের জন্য তা অব্যাহত রাখতে হয়।
সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধন প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বাড়তি অংশে ভূমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ ও ইঅ্যান্ডএম সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। পাশাপাশি ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টের (টিওডি) জন্য ভূমি বরাদ্দ ও নকশা তৈরি, ট্রেন পরিচালনার বিদ্যুৎ খরচ এবং এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার জন্য লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি তৈরি, ফুটপাত নির্মাণ, পরামর্শক ব্যয় এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চলবে। এসবের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বাড়ছে।
কমলাপুরে স্টেশন নির্মাণে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৩৬টি ছোট-বড় ভবন এবং অন্যান্য ৪০টি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রায় দেড় একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৬১ কোটি টাকা। এর বাইরে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মালিকানাধীন জমি বাবদ আরও ১ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে। নতুন করে ব্যয় বাড়ছে- বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্টে ৮৫২ কোটি টাকা, মেইন লাইনের সিভিল ও স্টেশন ওয়ার্কে ৪৩২ কোটি টাকা এবং ই অ্যান্ড সিস্টেম বাবদ ২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার অংশের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কাজ চলছে প্রকল্পের বাকি অংশেও। তবে মতিঝিল ছাড়িয়ে মেট্রোরেলের রুট কমলাপুর পর্যন্ত নেওয়ায় প্রকল্পের কাজ বেড়ে ব্যয়-মেয়াদও বেড়েছে।
আনন্দবাজার/শহক