শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
হাজার বছরের যন্ত্রণার অবসান

পদ্মার বুকে বিস্ময়

পদ্মার বুকে বিস্ময়
  • সারাদেশে আনন্দের ঢেউ, দক্ষিণে স্বস্তি-উচ্ছ্বাস
  • প্রমত্তা পদ্মাকে জয় করে দুপাড়ের মানুষকে সেতুবন্ধনে বেঁধে দেয়া বিশ্বের যেমন বিস্ময় তেমনি বিস্ময়করও

বিশ্বের সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ দুর্বিনীত নদীর নাম পদ্মা। সর্বনাশা এই নদীকে শাসন করে এপাড়-ওপাড়ের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা সত্যিই বিশ্বের বিস্ময়। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দক্ষতার সহায়তায় নেতৃত্বের বলিষ্টতা আর প্রবল ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে। এত ভয়ঙ্কর চরিত্রের নদীর ওপর দিয়ে সব বিপদ আর পরিবেশের ভয় উপেক্ষা করে শত বছরের নিশ্চয়তার সেতু তৈরি ছিল সত্যিই বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু তৈরির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ দেশ চীন বাংলাদেশের এই সেতু তৈরিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। সেইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেছে।

গতকাল শনিবার বিশ্বের বিস্ময় পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে ঢল নামে সর্বনাশা রাক্ষুসে পদ্মার এপাড়-ওপাড় জুড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর পূর্বপাড়ে মুন্সিগঞ্জের মাওয়াও জাজিরার নাওডোবা প্রান্তে উদ্বোধন কার্যক্রম শেষে যখন পশ্চিমপাড়ের কাঁঠালবাড়ি জনসভাস্থলে পৌঁছান তখন অন্যরকম চিত্র দেখা যায়। সভামঞ্চে তখন বাজানো হয় সর্বনাশা পদ্মা নিয়ে লোকগানের উজ্জ্বল নক্ষত্র শিল্পী আবদুল আলীমের ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’ গানটি।.. পাড়ির আশায় তাড়াতাড়ি/ সকাল বেলা ধরলাম পাড়ি/
আমার দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো/ তবু না কূল পাই..। গানটির সুর আর কথার মধ্য দিয়ে পদ্মার ভয়ঙ্কর রূপ-চরিত্রের স্মৃতি স্থানীয়দের তাড়িত করে।

এরপর বাজানো হয় হৃদয় উদাসী করা গান, ‘ও নদীরে, একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে’ গানটি।.. তোমার কোনো বাঁধন নাই/ তুমি ঘর ছাড়া কি তাই/ এই আছ ভাটায় আবার/ এই তো দেখি জোয়ারে/ বলো কোথায় তোমার দেশ…। এসময় সভামঞ্চ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে কেঁপে ওঠে। এসব গান আর স্লোগানের মধ্য দিয়ে যেন সর্বনাশা পদ্মা নদীকে জয় করার কথাই বলা হয়ে ওঠে। হাজার বছর ধরে নদী পারাপারের যন্ত্রণা আর দুর্ভোগের শেষ মুহূর্তে এসে অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন।

আরও পড়ুনঃ  পদ্মা ছাড়া প্রায় প্রধান সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে

পদ্মার পশ্চিমপাড়ে কাঁঠালবাড়ি ঘাট এলাকায় যখন পদ্মাসেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন লাখো, হাজার দর্শনার্থীরা, ঠিক সেই মুহূর্তেই রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া আর মানিকগঞ্জের পাটুরিয়াঘাটে ছিল শত শত যানবাহন দীর্ঘ সারি। চিরকালীন সেই ফেরিপারের অপেক্ষার চিত্র। যুগ যুগ ধরে এই দুর্ভোগ সঙ্গী করে যাতায়াত করলেও গতকাল ছিল অন্যরকম এক আনন্দের দিন। একমাত্র ভরসা লঞ্চ বা নৌকার অবসান ঘটিয়ে সেতু পথে পদ্মা পারের ঘটনা যে হাজার বছরের বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের খবরে তারা দারুণ খুশি। যাত্রী আর পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যেও ছুঁয়ে যাচ্ছিল আনন্দ আর উল্লাস। তাদের আলোচনা ঘিরে থাকে পদ্মা সেতুর মাহাত্ম।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে প্রাণের টান আর উচ্ছ্বাসে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছুটে এসেছিলেন হাজারো মানুষ। ঠিক একই সময়ে কাঁঠালবাড়ি সড়কে বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ করছিলেন অর্ধশতাধিক তরুণ। তাদের অনেকেই এসেছিলেন দক্ষিণের জেলাগুলো থেকে। তারা বলছিলেন, আজ কালের সাক্ষী হতেই আমরা এসেছি। পদ্মাপাড়ে দাঁড়িয়ে উদ্বোধন ঘোষণা শুনে ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। আমরা যারা দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানীসহ মধ্যঅঞ্চলে আসতাম তাদের কী যে দুর্ভোগ পোহাতে হতো, বলে বোঝানো যাবে না। কত স্বপ্ন যে আমাদের বির্বণ হতো, মরে যেত, তা আর বলার মতো নয়। আজ সেই ভয়ঙ্কর দুর্ভোগের অবসানের দিন।

ঘাটের অনেকেই বলছিলেন, তারা দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানীতে কাজের সন্ধানে আসতেন। কাজও খুঁজে পেতেন। তবে ঘরে ফেরা কিংবা স্বজনদের যেকোনো বিপদে আপদে তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনে ইচ্ছার কোনো স্বাধীনতা থাকতো না। সব স্বপ্ন আর ইচ্ছা বাঁধা পড়ে থাকতো ঘাটের পারাপারে। কেউ মারা গেলেও দ্রুত আর সহজে পৌঁছানোর কোনো উপায় থাকতো না। ঘাট আর নৌরুট আমাদের অনেক স্বপ্নকে খুন করতো। এর ওপর ঈদ কিংবা বড় কোনো উৎসবে ঘরে ফেরার তাড়া থাকলেও মৃত্যুর হাতছানি থাকতো পদে পদে। সেই দিনের অবসান হচ্ছে আজ। এত বড় সুসংবাদ আর কী হতে পারে আমাদের জন্য। তাই তারা সেই উচ্ছ্বাস আবেগ প্রকাশের জন্যই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছুটে এসেছেন।

আরও পড়ুনঃ  দেশে আনা যাবে না লিবিয়ায় নিহত বাংলাদেশিদের মরদেহ

শেষবারের মতো যারা দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে নদী পাড়ি দিচ্ছিল তারাও ছিল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। গতকাল ফেরিঘাট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দের ওয়াজেদ চৌধুরী টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ঢাকামুখী যানবাহনের সারি ছিল। যার মধ্যে বেশির ভাগ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পণ্যবাহী গাড়ি। ফেরিঘাট এলাকার প্রায় এক কিলোমিটার সড়কে পণ্যবাহী গাড়ির সঙ্গে যাত্রীবাহী বাসও ছিল। এমন চিত্র আর দেখা যাবে না আগামীতে।

গতকাল শনিবার বেলা ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী যখন কাঁঠালবাড়ির জনসভা মঞ্চে যেতে রওনা দেন, তখন জাজিরা ও শিবচর প্রান্তে থাকা লাখো জনতা উল্লাসে ফেটে পড়েন। তরুণেরা মিছিল করেন, বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ করতে থাকেন। সাধারণ মানুষের বাঁধভাঙা উল্লাস শুধু পদ্মার দুই পাড়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা বাংলাদেশেই।

দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলাকে সংযুক্ত করেছে পদ্মা সেতু। এসব জেলার উল্লসিত মানুষ ছাড়াও পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছুটে এসেছেন দেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দারাও। তাদের বাঁধভাঙা আনন্দই জানিয়ে দেয়, পদ্মা সেতু শুধু সেতুই নয়, বিশ্বের যেমন বিস্ময় তেমনি গোটা দেশের মানুষের আবেগও। প্রমত্তা পদ্মা নদীকে জয় করে দুপাড়ের মানুষকে সেতুবন্ধনে বেঁধে দেয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিস্ময়, বিস্ময়কর।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন