শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
স্বপ্নের সেতু-

আজন্ম লালিত স্বপ্নের নাম

আজন্ম লালিত স্বপ্নের নাম

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তথা সারাদেশের মানুষের এক অবারিত স্বপ্নের নাম পদ্মা সেতু। অনেক বাধা বিপত্তি আর প্রতিকুলতা পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত এক স্বপ্নের নাম পদ্মা সেতু। অনেক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে মাথা উঁচু দাঁড়ানো এক সফলতার নাম পদ্মা সেতু। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অদম্য আগ্রহ আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পদ্মাসেতু শুধুই একটি সেতু নয়, একটি অঞ্চলের মানুষের আজন্ম লালিত একটি স্বপ্নের নাম।

ফেরিঘাটে অ্যাম্বুলেন্স আটকে মাকে হারানো সন্তান জানে পদ্মা সেতু কী। দুইতিন ঘণ্টা দেরি হওয়াতে ইন্টারভিউ দিতে না পারা বেকার ছেলেটি জানে পদ্মা সেতু কী। কুয়াশার কারণে ফেরি বন্ধ হলে ফ্লাইট মিস করা রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসী জানে পদ্মাসেতু কী! সারাবছর পরিচর্যার পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিঘাটের গরমে থেকে বস্তায় পচা সবজিগুলো দেখা কৃষকটি বলতে পারবে পদ্মা সেতু কী। প্রচণ্ড ঝড়ে পদ্মায় ট্রলারসহ ডুবে যাওয়া সন্তানকে খুঁজে না পাওয়া বাবা মা জানে পদ্মা সেতু কী। এই সেতু সাধারণ সেতু নয়, পদ্মা সেতু কখনোই একটি সাধারণ সেতু ছিলো না। পদ্মা সেতু তৈরি করা নদীর নিচে ৫০ তলা বাড়ির সমান পাইলিং করার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো।

পদ্মার দুপারের মানুষ যারা সেই পথ ব্যবহার করে তারা জানে এই সেতুর প্রতিটি স্প্যান শত আবেগ আর শত গল্পের বুক চিরে দাঁড় করানো হয়েছে। বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতুর  নাম পদ্মা সেতু। সেতুটি নির্মাণের জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এই সেতুর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড সেতুর নকশা প্রণয়ন করেছে আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম AECOM। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। প্রস্থ ১৮ দশমিক ১০ মিটার। যার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্ব পালন করছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রতিদিন গড়ে ৭৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে এ সেতু দিয়ে। এর পিলার ৮১টি। মোট স্প্যান সংখ্যা ৪১। প্রতিটি স্পেনের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং প্রতিটি স্পেনের ওজন ৩ হাজার ২০০ টন। পানির স্তর থেকে এই অত্যাধুনিক সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট এবং এর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট। সেতুর উপরের তলায় চার লেনের সড়ক এবং নিচতলায় থাকবে রেললাইন। সংযোগ সড়ক হচ্ছে জাজিরা ও মাওয়া। সংযোগ সড়কের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। দুই পাড়ে নদী শাসন ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলার সঙ্গে সংযোগ ত্বরান্বিত হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে বিশেষজ্ঞ দলের একজন সদস্য ড. আইনুন নিশাত, যিনি নদী ব্যবস্থাপনার কাজ তদারকি করেছেন, তিনি বলছেন পদ্মার তলদেশে এবং দু’পাশে নরম মাটি ও বালি। একারণে কাজটা ছিল বেশ কঠিন ও জটিল। তিনি বলেন-

আরও পড়ুনঃ  লাউয়াছড়ায় কঙ্কাল

নরম হওয়ার কারণে নদীর তল অনেক গভীরে চলে যেতে পারে অথবা দুই পাশ ভাঙতে পারে। শীতের সময় পদ্মা নদীতে গভীরতা থাকে ১০০ ফুটের কাছাকাছি। বর্ষার সময় এই গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। একারণে চ্যালেঞ্জ ছিল নদীর ওই গভীরতায় সেতুর যেসব পাইল বসানো হবে সেগুলোর ফাউন্ডেশন তৈরি করা’।

উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা সেতুটি পরিবহন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞ মহল। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান এর মতে ‘সরকারের ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে পদ্মা সেতু একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের কাজ করবে। এই সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের শেষ ভৌগলিক বিভাজন শেষ হতে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এই সেতুর মাধ্যমে সংযোগের আওতায় আসতে যাওয়া ২১ জেলার মধ্যে ১৩টিতে দারিদ্র্যের হার বাংলাদেশের গড় দারিদ্র্য হারের চাইতে বেশি। এই জেলাগুলো দেশের মূলধারায় আসলে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির দরজা খুলবে।’ তিনি আরো  বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে মোট দেশজ উৎপাদনের  আকার ১.২৩ শতাশং বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলো জিডিপিতে আরও দুই শতাংশের বেশি যোগ করবে। ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির আড়াই শতাংশ হিসাবে সেতুটি থেকে আসবে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এ হিসাবে নির্মাণ ব্যয়ের অন্তত সাড়ে তিনগুণ বেশি সুফল আসবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, পদ্মা সেতুর বড় ইতিবাচক দিক হলো এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া সড়কটি এক্সপ্রেসওয়ে হিসেবে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে। এই সড়কে ধীরগতির যানবাহন প্রবেশ করতে না দেয়ায় দুর্ঘটনার পরিমাণ কমে আসবে। তিনি বলেন, সরকার সেতু ও সড়ক নির্মাণ করে উন্নয়নের মেরুদণ্ড তৈরি করে দিয়েছে। এখন চারপাশে বেসরকারি খাতে এলোমেলো উদ্যোগ নিলে এই উন্নয়ন টেকসই হবে না। এই কারণে রাস্তার দুই পাশে পরিকল্পিত উন্নয়ন করতে হবে।’

আরও পড়ুনঃ  দক্ষিণ এশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ

এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রীর একটি সাহসী পদক্ষেপ। চাপের মধ্যেও পদ্মা সেতু নির্মাণে সফলতা বড় শক্তির পরিচায়ক। পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সেতুটি নির্মাণের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, দেশের জিডিপি বছরে ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় জিডিপি ২.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে পারে। সেতুটি নির্মাণ হলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। ঢাকা থেকে মাওয়া-ভাঙ্গা-যশোর-খুলনা রেল সংযোগ স্থাপন করা হবে। ঢাকা থেকে খুলনা, মংলা, বরিশাল, কুয়াকাটা অর্থনৈতিক করিডোর খুলে যাবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সুবিধা হবে। নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক স্থাপনের ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে। পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হবে এবং মাওয়া ও জাজিরায় গড়ে উঠবে নতুন রিসোর্ট ও হোটেল, শপিংমল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

দুর্নীতির অজুহাত এনে পদ্মা সেতু তৈরিতে অর্থ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। আর বিশ্বব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নিজস্ব অর্থায়নেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। কারিগরি দিক দিয়ে চীন, জাপান, কোরিয়া, রাশিয়াসহ বেশকিছু দেশ পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। চীনের বেশ কয়েকটি কন্সট্রাকশন কোম্পানির শত শত ইঞ্জিনিয়ার এবং শ্রমিক বিশাল এই প্রজেক্টে দিনরাত কাজ করেছেন। তবে সেতু নির্মাণে অর্থায়নের পুরোটাই এসেছে দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকা, রেমিটেন্সের ঘাম ঝরানো টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের টাকা থেকে।

আরও পড়ুনঃ  অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৬৪৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দ ২৮০ এমপির জন্য

এই সেতুর ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থমন্ত্রণালয়ের সাথে ২৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সেতু বিভাগ। ১ শতাংশ সুদসহ ৩৫ বছরে ১৪০ কিস্তিতে এই ঋণ শোধ করতে হবে সেতু বিভাগকে। আর এই অর্থ সেতু বিভাগ আয় করবে পদ্মা সেতু থেকে পাওয়া টোলের টাকা থেকে। ইতিমধ্যেই কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন এবং চায়না মেগাব্রীজ ইঞ্জিনিয়ারিং নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে এই টোলের টাকা আদায়ের জন্য ৫ বছরের চুক্তি করা হয়েছে।

বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প যেমন- পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প, চট্রগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প, মেট্রো রেলসহ একাধিক উন্নয়নমূলক মেগা প্রকল্পের শীর্ষে ছিল এই পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ  প্রকল্পটি। শুধু শীর্ষেই নয় বরং এটি ছিল এ  সরকারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা আর সাহস সততার এক অনন্য দৃষ্টান্ত এই পদ্মা সেতু।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন