দেশে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে ডায়রিয়া, সাপের কামড়, পানিতে ডুবে ও আঘাতজনিতসহ নানা কারণে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে সিলেট বিভাগে ২১ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম সই করা এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বন্যাকবলিত চার বিভাগে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে তিন হাজার ৪০৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ১৭ জুন থেকে ২২ জুন পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৫১৬ জন, রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনে (আরটিআই) ১০৩ জন, চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১৬৩ জন, চোখের প্রদাহে ৬১ জন, আঘাতপ্রাপ্ত ৩৯ জন ও অন্যান্য সমস্যায় পতিত হয়েছেন ৪৮১ জন। এই সময়ে বজ্রপাতে আক্রান্ত ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে, সাপের কামড়ে চারজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে এবং পানিতে ডুবে মারা গেছেন ২৩ জন। এছাড়াও গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩৭ জন, আরটিআইতে ১৬ জন, চর্মরোগে ২৩ জন, চোখের প্রদাহ ১৫ জন ও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন ১৪ জন, এছাড়াও অন্যান্য কারণে আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ জন। এই সময়ে পানিতে ডুবে মারা গেছেন চারজন।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর পৌর এলাকার বাসস্ট্যান্ড কলোনিতে ১৬ জুন দুপুরে সন্তানের জন্ম দেন তানিয়া বেগম। তবে ওই রাতেই তাঁদের ঘরে বন্যার পানি ওঠে। উপায় না পেয়ে পরের দিন সকালে নবজাতককে নিয়ে তানিয়া উপজেলা সদরের আবদুস সামাদ আজাদ অডিটোরিয়ামের আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। ওই দিন থেকে পাঁচ শতাধিক বন্যাকবলিত মানুষের সঙ্গে নবজাতককে নিয়ে তানিয়া আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছেন। তবে ঠিকমতো বুকের দুধ না পাওয়ায় নবজাতককে নিয়ে তানিয়া বিপাকে পড়েছেন। হাতে টাকা–পয়সা নেই বলে দুধ কিনে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্যও নেই বলে জানিয়েছেন তানিয়া।
গত ১৬ জুন থেকে উজানের ঢল ও প্রবল বর্ষণে সুনামগঞ্জ শহরসহ প্রতিটি গ্রাম প্লাবিত হয়। পরদিন ১৭ জুন ভোরের দিকে হঠাৎ করে ঢলের পানি চার থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতায় বাড়ি-ঘরসহ জনপদে প্রবেশ করতে থাকে। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে একতলা ঘরবাড়ি মুহূর্তেই পানির নিচে চলে যায়। উঁচু কবরস্থান-শ্মশানেও গলা থেকে তার চেয়ে বেশি উঁচুতে পানি ছিল। এ অবস্থায় স্বজনদের মরদেহ কফিনে ঢুকিয়ে কবরে নিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন কেউ কেউ।
বন্যায় সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারে গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটকের মোট ৩,৬১৭টি নেটওয়ার্ক সাইটের মধ্যে ২০০৮টি সাইট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যেই পুনরায় সচল করা সম্ভব হয়েছে ১,২৫৫টি সাইট। অবশিষ্ট ৭৫৩টি সাইট সচল করার জন্য কাজ চলছে। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -১ এ সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ইন্টারনেটসহ টেলিযোগাযোগ সংযোগ স্থাপনে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ১২টি ও বিএসসিএল- এর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আরও ২৯টি ভিস্যাট স্থাপনে কাজ করছে।
এদিকে সুনামগঞ্জে বন্যার পানি ক্রমেই কমছে। তবে বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ। সেই সঙ্গে দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত নানা রোগবালাই। জেলায় গত তিন দিন বৃষ্টি হয়নি। তাই বন্যার পানি আরও কমেছে। মানুষের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট থেকে পানি নামছে। তবে শহরের অনেক রাস্তাঘাট, বাড়িঘরে এখনো পানি আছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে শহরের পাড়া–মহল্লায়, রাস্তাঘাটে ভেসে উঠছে ময়লা-আবর্জনা। ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগবালাইয়ে। এর মধ্যে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটে ব্যথা, জ্বরসহ নানা চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ।
সেনাবাহিনীর একটি দল সকাল থেকে শহরের শহীদ আবুল হোসেন মিলনায়তন প্রাঙ্গণে মানুষদের চিকিৎসাসেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দিচ্ছে। অনেক নারী-পুরুষ সেখানে সেবা নিচ্ছেন। চিকিৎসা দলে থাকা ক্যাপ্টেন কাজী তানজিদুর রহমান জানান, মানুষজন পানিবাহিত রোগ নিয়েই বেশি আসছেন। এ চাড়া চর্মরোগও আছে। তাঁরা সবাইকে প্রয়োজনীয় সেবা ও ওষুধ দিচ্ছেন।
বন্যায় নেত্রকোণার ১০টি উপজেলার ৭৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি রয়েছে ১০ লক্ষাধিক মানুষ। এর মধ্যে জেলার ৩২৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে দেড় লক্ষাধিক মানুষ। বেশির ভাগ লোকজনই বসবাস করছে পানিবন্দি অবস্থায়। পানিতে তলিয়ে জেলার অন্তত ২৫ হাজার পুকুর, ৬ শতাধিক হাঁস-মুরগির খাবার ও সহস্রাধিক হেক্টর জমির আউশ ধান, পাটসহ সবজি জাতীয় ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা কৃষি ও মৎস্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। জেলার ১০ উপজেলার মধ্যে নেত্রকোণা সদর, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, মদন, আটপাড়া ও কেন্দুয়ার ৮৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭৫টি ইউনিয়নই বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলাবাসী। বন্যায় জেলার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
তবে দুদিন ধরে বৃষ্টিপাত না থাকায় এবং উজানের ঢলের পানি বন্ধ থাকায় ধীরগতিতে কমতে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। উঁচু এলাকার পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও গ্রাম এলাকার বাড়িঘর থেকে বন্যার পানি নামেনি। এ অবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া দেড় লক্ষাধিক মানুষ কিছুটা ত্রাণসহায়তা পেলেও চরম খাদ্য-সংকটে রয়েছে প্রত্যন্ত এলাকার পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে শিশু খাদ্য ও পশুখাদ্যের সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
অন্যদিকে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্য তিন দিনে দেড় কোটি টাকা সংগ্রহ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আহ্বানের পর দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন মাধ্যমে তার কাছে এই অর্থ পাঠিয়েছেন।
আনন্দবাজার/শহক