ষাটোর্ধ্ব হাবিবুর রহমান। শিবচরের বাংলাবাজার লঞ্চঘাটের টার্মিনালে বসে কাঁচা চিপস বিক্রি করেন। সঙ্গে বাদাম, কালোজিরা, সরিষা, মেথিসহ নানারকম শুকনা খাবারও বিক্রি করেন। সেতু চালু হলে বন্ধ হয়ে যাবে ঘাট। ছেদ পড়বে তার দীর্ঘদিনের ব্যবসাতে। কিন্তু তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই। পদ্মাসেতু চালু হচ্ছে এটাই তার কাছে সবচেয়ে বড়। হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এখনে তো ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এখন যেমন বিক্রি হয়, সে রকম আর হবে না। তাতে কি, পদ্মাসেতু তো আমরা পাইলাম। এই সেতুর কারণে এলাকার যে উন্নয়ন হইতাছে তাতে আমাগো ছেলে-মেয়েরা, তাগো ছেলে-মেয়েরা বড় ধরনের উপকার পাইবে। আমাগো জীবন তো শ্যাষের দিকেই!
হাবিবুরের মতো ঘাট এলাকার অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যবসা ঘাট বন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যাবে। নতুন কোনো স্থান খুঁজে নিতে হবে তাদের। নতুন করে আবার শুরু করতে হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। জীবিকা নির্বাহে অনেকটাই ছেদ পড়বে তাদের। তবে পদ্মাসেতু নিয়ে গৌরবের শেষ নেই তাদের। পদ্মাসেতুর কল্যাণে পদ্মার চরাঞ্চলের মানুষ আধুনিক জীবনের সুবিধা পেতে যাচ্ছে। অবহেলিত জনপদে পাকা ঝকঝকে রাস্তা, গড়ে উঠছে নানান অবকাঠামো। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে উঠবে ‘মিনিটের ব্যাপার’। এসব ভেবেই তারা আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত।
হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিদিন ৫/৭ শত টাকার মতো বিক্রি হয়। এই নিয়েই সংসার চলে। বেশ ভালোই আছি। সেতু চালুর পর ঘাট বন্ধ হলে গেলে অন্য কোথাও যাবো। মহাসড়কের আশেপাশের কোনো বাজারে দোকানের ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরেই ঘাটে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে আসছি। হঠাৎ করে ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাবে; খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পদ্মাসেতুও কম নয়। আমার জীবনে কল্পনাও করিনি এই নদীর ওপর সেতু হবে। পদ্মাসেতু উদ্বোধন হবে ২৫ জুন। আমাদের সকলের মনেই আনন্দের জোয়ার বইছে। পদ্মা পাড়ের মানুষের ঘরে ঘরে যেন উৎসবের আগমনী বার্তা। দূরের আত্মীয়-স্বজনেরা বেড়াতে আসছে সেতু দেখতে।
বাংলাবাজার লঞ্চ টার্মিনালে খাবার হোটেলের মালিক ইস্কান্দার শেখ। ৪০ বছর ধরে খাবার হোটেলের ব্যবসায় তার। প্রথমে কাওড়াকান্দি, এরপর কাঁঠালবাড়ী, শেষে বাংলাবাজার ঘাট। পদ্মাসেতু চালু নিয়ে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই তার। ইস্কান্দার শেখ বলেন, অনেক ব্যবসায়ীর মন খারাপ। পদ্মাসেতু চালু হলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে এমনটা ভাবছেন তারা। এটা আসলে ঠিক ভাবনা নয়। ব্যবসা বন্ধ হবে না, স্থান পরিবর্তন হবে। পদ্মাসেতুর কারণে এই এলাকায় পদ্মার পাড়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘুরতে আসে। পদ্মার পাড়ে যেখানেই দোকান দেই আশা করি চলবে। পদ্মাসেতু চালু হইবে। মনের মধ্যে অটোমেটিক আনন্দ আইসা পড়ে।
ইউনুস নামের আরেক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, সেতু চালুর পর সেতুর কাছেই হোটেল দিমু। আমাদের বাড়িও জাজিরার টোলপ্লাজার কাছে। সেতুর কারণে আমাদের এলাকার চেহারা পাল্টে গেছে। শহর হয়ে যাচ্ছে আমাদের এলাকা। পদ্মা সেতুর অদূরে বাড়ির কাছে জায়গা আছে, সেখানেই হোটেল দিমু। অনেকেই সেতুর কাছে, মহাসড়কের পাশের বাজারে হোটেল-দোকান নেয়ার চিন্তা করছে।
আসছে ২৫ জুন প্রমত্ত পদ্মার উপর নির্মিত দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। উদ্বোধনকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মনে বইছে উচ্ছ্বাসের হাওয়া। অপেক্ষার যেন শেষ হচ্ছে না। ঘর থেকে শুরু করে হাটে-মাঠে-ঘাটে বা চলার পথেও এখন পদ্মা সেতুর গল্প। রাজধানী ঢাকায় যেতে নির্বিঘ্নে সেতু পার হবার গল্প! পদ্মাসেতু যেন এক আবেগ পদ্মাপাড়ের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে। তাই ঘাট কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগের মনেই খুব একটা দুঃখ নেই। ঘাট বন্ধ হলে ব্যবসায়ের জায়গা থাকছে না, আগের মতো বেঁচাকেনা থাকবে না, কমে যাবে উপার্জন’- এই ভাবনা ম্লান, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবার আনন্দের কাছে।
আনন্দবাজার/শহক