বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
পানিবন্দি ৪০ লাখ মানুষ---

মহাবিপর্যয় রূপে বন্যা

মহাবিপর্যয় রূপে বন্যা
  • বড় বিপদ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা

সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারী বৃষ্টিতে নদনদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যার আরও বিস্তৃতি ঘটেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার ও আর্তনাদ চলছে। আশ্রয়ের খোঁজে পানি-স্রোত ভেঙে ছুটছে মানুষ। সবচেয়ে বিপদে আছেন শিশু ও বয়স্করা। আটকে পড়াদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। যেখানেই শুকনো ও উঁচু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে মানুষ।

নিরাপদ স্থানে বা জরুরি কাজে যেতে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছাড়া উপায় নেই। এ অবস্থায় মাঝিরা নৌকার ভাড়া ১০ গুণ বেশি হাঁকছেন। এরপরও নৌকা পাচ্ছে না বন্যায় দুর্ভোগের শিকার হওয়া মানুষ। সিলেটের ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর মধ্যে একটি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। সালুটিকর এলাকায় বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়ক। এতে সিলেটের সঙ্গে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সড়ক পথের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

মেঘালয়ের বৃষ্টির পানি এসে সিলেট বিভাগে হঠাৎ বড় বন্যা সৃষ্টি করেছে। এই বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ সুনামগঞ্জে। জেলাটির ৯০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। ওদিকে আসামের বৃষ্টির পানি ঢল আকারে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এতে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও রংপুরের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে গতকাল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। জুন মাসের বৃষ্টিপাতের বিবেচনায় এটা ১২২ বছরের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি)। শুধু মেঘালয় নয়, তিন দিন ধরে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে ভারতের আসামেও।

আরও পড়ুনঃ  সিলেটে বাড়ছে বন্যার পানি, ঘরবন্দি সাড়ে ৬ লাখ মানুষ

গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১টার মধ্যে নতুন করে নগরের অন্তত ২৫টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে সিলেট নগররের পুরোটা কার্যত প্লাবিত হয়ে পড়ল। এ অবস্থায় দুর্ঘটনা এড়াতে এসব স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় কোমর থেকে গলাসমান পানি দেখা গেছে।

পুলিশ-সেনাসদস্যদের পাশাপাশি সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মানবিক সাহায্যে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় খোলা হয়েছে বন্যায় উদ্ধার কাজের মনিটরিং সেল। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেটের সব স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে স্ট্যান্ডবাই ডিউটিতে মোতায়েন রাখা হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্ধার তৎপরতায় সহযোগিতা ও মানবিক কার্যক্রমে অংশ নিতে এবার নামছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি ডুবুরিদল। এছাড়া উদ্ধার তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার ও কোস্ট গার্ডের দুটি ক্রুজ। এরই মধ্যে নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি দল সিলেটে পৌঁছে কাজ শুরু করেছে।

এদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে রেললাইন। তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন। তবে জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা থেকে সারাদেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক রয়েছে। গতকাল সকালে সিলেট স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ‘কালনী এক্সপ্রেস’ এবং ‘জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস’ ছেড়ে গেছে। এরপর আর কোনো ট্রেন আসেনি এবং ছেড়েও যায়নি। এর আগে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পানি ঢুকে পড়ায় সিলেটের কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

সিলেটের কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্রে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে শনিবার দুপুর সোয়া ১২টা থেকে পুরো সিলেট বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।  বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) বিভাগীয় প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কাদির জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বন্যার পানি প্রবেশ করায় সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। পানি নামানো গেলে আবারও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। পানি বাড়তে থাকায় হাসপাতালগুলোও তলিয়ে গেছে। সংকটাপন্ন এই সময়ে ব্যাহত হচ্ছে এই অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।

আরও পড়ুনঃ  দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যার সতর্কতা

অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বানভাসি মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় ইমার্জেন্সি কন্ট্রোল রুম চালু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এছাড়াও পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে একটি সেন্ট্রাল মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। একইসঙ্গে তিন সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ডকে সিলেটে পাঠানো হয়েছে। তারা সরেজমিনে বন্যার সার্বিক অবস্থা এবং স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন।

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, মৌসুমি বায়ু হঠাৎ করে তীব্র শক্তি নিয়ে হিমালয়ের উঁচু পাহাড়গুলোতে আছড়ে পড়ছে, যা ভারী বৃষ্টি তৈরি করছে।  এদিকে বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের মেঘালয় ও আসামে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশে উজান থেকে পানি আসা বন্ধ হবে না। সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির আশা নেই। দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আগামী দুই দিনের মধ্যে আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।

কী কারণে এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হলো, এর ব্যাখ্যায় বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ সংগঠকেরা বলছেন, সিলেটের প্রতিটি নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। মূলত, ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য মোটাদাগে এসব কারণই প্রধানত দায়ী।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন