স্বাস্থ্যখাতে গত বছরের চেয়ে ২ শতাংশ বাজেট কমেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, আমাদের বাজেটে নানা প্রতিবন্ধকতা অনেক। আছে অর্থছাড়ের দীর্ঘসূত্রিতাও। প্রকল্প বাস্তবায়নে পদে পদে বাধা। এসব বাধার কারণে গত অর্থবছরে পাস হওয়া চার হাসপাতালের মধ্যে তিনটির কাজই শুরু করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের উদ্যোগে ‘কেমন হলো স্বাস্থ্য বাজেট ২০২২-২৩’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বাজেট শুধু হিসেবে খাতা নয় বরং মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার দলিল। সরকারের মানুষের জন্য কোন কোন বিষয়ে উন্নয়নে জোর দিবে তা উল্লেখ করা হয় তাতে। থাকে বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন। তা ছাড়া আগামীতে কি কাজ করা হবে তাও উল্লেখ থাকে। নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী বাজেট দিতে হবে। সামগ্রিক বাজেটটি ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে আগামী বছরে মাথাপিছু আয় হবে ৩ হাজার ডলার। তিনি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, অর্থাৎ ১৪ শতাংশ থাকলেও চলতি বাজেটে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা অথাৎ ১২ শতাংশ হয়েছে। চলতি বাজেট আরো বাড়ানো দরকার ছিল। গতবছরে করোনায় ১০ হাজার কোটি থাকলেও এবার ৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেটে সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত জিনিসে ট্যাক্স ধরা হয়নি। বিলাসী পণ্যে ধরা হয়েছে। শিল্পের কাঁচামালে ট্যাক্স কমানো হয়েছে। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ কর্মবাজারে ঢুকে তাদের কাজ দেয়া দরকার।
জাহিদ মালেক বলেন, এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ট্যাক্স রেট বাড়ানো হয়নি। ৪ কোটি ট্যাক্স দিতে পারলেও দেয় মাত্র ৩০ লাখ মানুষ। ১২ শতাংশ হিসেবে ৪ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। আমদানিপণ্যে কর কমানো হয়েছে। অসংক্রমণ ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে দিকনির্দেশনা দেয়া আছে। ভ্যাক্সিন তৈরির নির্দেশনা দেয়া আছে। প্রিভেন্টিক কেয়ার তথা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় জোর দেয়া হচ্ছে।
বাজেট বাস্তবায়ন ধীরগতি বিষয়ে বলেন, পিডব্লিউ’র কারণে প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয়। সেখানে আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা বেশি সময় লাগিয়ে ফেলে। বৈদেশিক কারণেও হয়। এ জন্য অনুমোদিত ৪টির মধ্যে ৩টি মেডিকেলের কাজও শুরু করা সম্ভব হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়েও দীর্ঘসূত্রিতা আছে। তাদের প্রসেস তথা টেন্ডারিং দেরি হয়। জিনিসপত্রে দাম বাড়ে অথচ আমরা তাকিয়ে থাকি কখন কমবে তখন ব্যয় করবো। প্রস্তাবিত বাজেট সময়ত ও প্লানিং করতে পারি, অর্থছাড় তাড়াতাড়ি করতে পারলে ভালো হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনার টিকার ক্ষেত্রে সর্বক্ষেত্রে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় আমেরিকা ৮০, কানাডা ৬০, পাকিস্তান ২৩ আর বাংলাদেশ ৫ম। স্বাস্থ্যসেবাকে ডিজিটালাইজেশন শুরু করা হয়েছে। পলিথিন বন্ধ হওয়া দরকার। এটি স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে পরিবেশ সবদিকেই ক্ষতি করে। এ জন্য এখানে করারোপ বৃদ্ধি করা দরকার। এমনকি পর্যায়ক্রমে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে।
বুধবার রাজধানী ঢাকার মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হল রুমে সংগঠনটির সভাপতি রাশেদ রাব্বির সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক।
শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরারে সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল ও সহ-সভাপতি সেবিকা দেবনাথ মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এম এ আজিজ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির প্রমুখ।
মাইনুল হাসান সোহেল বলেন, আমাদের দেশে ২.৩ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়। মাথাপিছু ব্যয় হয় মাত্র ৪৫ ডলার। যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।
সেবিকা দেবনাথ বলেন, নাগরিকদের পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবায় ৬৮ শতাংশ করতে হচ্ছে। অথচ সংবিধানে এটিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে জিডিপির ২.৩ শতাংশ নেয়া হয়। যা নেপালের চেয়েও ১৩ শতাংশ কম।
অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, কেন বাজেট বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না সে সম্পর্কে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশিরভাগ সময়ই উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করতে পারে না। এটি ২০-২২ শতাংশ ব্যয় হয় না। যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় বাজেট খরচ করা যাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাস করতে দেরি হয়। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিভাগের মামলাগুলো দ্রুত সময়ে সমাধান করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবতে হবে। জরুরি ফান্ডে ৩০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সমস্যাগুলো কেটে যাবে।
অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বাজেটে চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলেন, দ্বিতীয় প্রেক্ষিত ২০৩১ অনুযায়ী এটি ভালো হয়েছে। আমাদের দক্ষ জনবলের অভাব আছে। এ জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট দরকার। আন্ত:ক্যাডার সমস্যার কারণে মন্ত্রণালয় টেকনিক্যাল মতামত নেয় না। এমনকি আমাদের কাজের নিরাপত্তাও নেই। তিনি বলেন, ক্রয় নীতিমালায় আধুনিকায়ন না করলে দুর্নীতি মুক্ত করা সম্ভব না। স্বাস্থ্যসেবার ৬৬ শতংশ বেসরকারি। তাদের জন্য আলাদা অধিদপ্ত হলে মনিটরিং বাড়বে। পদ শুন্য অথচ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। কর্মকর্তারদের পদও তৃতীয় গ্রেডে এটির উন্নয়ন হওয়া দরকার।
অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, অর্থছাড়ের সময় কমাতে হবে। বর্তমানে আমাদের যে খরচ দেয়া হয় তার চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি হওয়া দরকার। এপ্রিলে টাকা ছাড় দেয়া হয়। এটি আরো এগিয়ে আনতে হবে। আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে বরাদ্দ দেয়া হলে কাজের সুবিধা হয়। এপ্রিলের পরে কোন বরাদ্দ নয়। তিনি অবৈধ ক্লিনিক বন্ধ সম্পর্কে বলেন, আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। এতে জন মানুষের সাড়া ছিল। অবৈধ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে নীতিমালা দিয়ে মনিটরিং করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিমা করে নিজের পকেট থেকে ব্যয় কমানো সম্ভব মন্তব্য করে বলেন, টিকা নিলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না। যেখানেই দুর্নীতি পাবেন তা তুলে ধরলে আমাদের কাজ করতে সুবিধা হবে।
আনন্দবাজার/শহক