শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সোনায় মোড়ানো সড়ক

সোনায় মোড়ানো সড়ক

উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত বগুড়া জেলা শহরের ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশেই শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস্থান। তবে শহরের ভেতর দিয়ে কোনো সংযোগ সড়ক না থাকায় দীর্ঘপথ ঘুরে হাসপাতালে আসতে হয় রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের। প্রতিনিয়ত যানজটের কারণে মুমূর্ষু রোগীদের ভোগান্তির চিত্র নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলে জরুরি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতে যানজটে বেগ পেতে হয় রোগীদের।

এমতাবস্থায় মানুষের দুর্ভোগ লাগবে বগুড়া শহর ও মেডিকেল কলেজের মধ্যে নিরাপদ, দ্রত ও যানজটমুক্ত যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ১.৮৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের একটি প্রকল্প নেয় সরকার। ২০১৭ সালের জুন থেকে শুরু হয়ে প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটির তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করেও কাজ শেষ করা যায়নি। দুর্ভোগ লাগবের প্রকল্পটি এখন নিজেই দুর্ভোগে পড়ে আছে। কাজ কবে শেষ হবে তাও অজানা।

সর্বশেষ গত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে ৭৫.৯২ শতাংশ বা ৭৯ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৪ কোটি টাকা। ফলে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৯৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। প্রতি মিটারে ব্যয় প্রায় ১০ লাখ টাকা। আর প্রতি ইঞ্চিতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার টাকার মতো। একটি জেলা শহরের সংযোগ সড়কের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ করতে প্রায় শত কোটি টাকা খরচ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

কিলোমিটার প্রতি শত কোটি টাকা ব্যয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মূখ্য অর্থনীতিবীদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ছোট-বড় অধিকাংশ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দুই বা আড়াই গুণ সময়ের আগে শেষ হচ্ছে না। ব্যয়ের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। প্রকল্পের জন্য একটি টিম থাকে। এখানে তো জবাবতিহিতা থাকার কথা। সেটা কাজ করছে না কেন, সে প্রশ্নও রাখেন এ অর্থনীতিবিদ।

আরও পড়ুনঃ  ‘পচা’ বালুনদে ৫০ গ্রামের দুঃখ

তবে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নের এ প্রকল্পটি বর্ধিত এ সময়েও শেষ হবে কিনা সেটা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পটির মেয়াদ ৫ বছর শেষ হয়ে গেলেও গত বছরের পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি ছিল মাত্র ৪১ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি বা মোট ব্যয় হয়েছিল ৬৫ কোটি টাকা।

প্রথমবার প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০২১ সালে জুন পর্যন্ত আবারও মেয়াদ বাড়ানো হয়। আর সর্বশেষ তৃতীয় দফায় ২০২২ সালের জুন নাগাদ মেয়াদ বাড়ানো হয় মাত্র ২ কিলোমিটারেরও কম এ সড়কটি নির্মাণ করতে। পরবর্তীতে ব্যয় বৃদ্ধি করার প্রস্তাব রেখে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। সেখানে প্রকল্প মূল্যায়ন কিমিটির সভায় ব্যয় বাড়িয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) বা প্রকল্প প্রস্তাবনা পুনর্গঠন করা হয়।

বার বার মেয়াদ বাড়ানোর ‍বিষয়ে প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের বগুড়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মুহা. আসাদুজ্জামান জানান, ভূমি অধিগ্রহণে অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজনে প্রকল্প সংশোধন করতে গিয়ে একনেকের অনুমোদন নিতে ৩ বছর লেগে যায়। তবে বর্ধিত সময়ের মধ্যেও এ প্রকল্পের কাজ শেষে করা সম্ভব নয় বলে তিনি স্বীকার করে আগামী ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে জানান। যদিও একনেক সভায় ২০২২ সালের জুনে কাজ শেষ হবে বলে উল্লেখ আছে।

প্রকৌশলী মুহা. আসাদুজ্জামান ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বললে তাকে একনেকের সিদ্ধান্তের বিষয় স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বার বার ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করতে থাকেন। তাহলে একনেক থেকে এই প্রতিবেদককে সরবরাহ করা কাগজটি ভুল কিনা এমন প্রশ্ন করা হয়।

পরে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মুহা. আসাদুজ্জামান জানান, ২০২১ সালের অক্টোবরে একনেক থেকে এটা (ব্যয় বৃদ্ধি) অনুমোদনের কথা ছিল। সেখানে মেয়াদ বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছে। তবে একনেকে মেয়াদ বৃদ্ধি না হয়ে থাকলে সামনে আবার এটার মেয়াদ বৃদ্ধি করে নেয়া হবে বলে জানান এ সরকারি প্রকৌশলী। সেজন্য আগে থেকেই আবেদন জমা দেয়া আছে, যুক্ত করেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  সংসদে প্রধানমন্ত্রীর কান্না

এদিকে, কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প ব্যবস্থাপক এখনো ৬৫০ মিটার রাস্তার কাজ বাকি আছে বলে জানান। এ অংশের উচ্ছেদ বা অধিগ্রহণের কাজও এখনো বাকি রয়েছে। তার দেয়া তথ্যমতে, ১.৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১.২ কিলোমিটার রাস্তার কাজ হয়েছে মাত্র। প্রকল্পের কাজ করছে আমিরুল হক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকৌশলী মুহা. আসাদুজ্জামান জানান, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে সাফার করছে। ভূমির মূল্য বাড়ায় একনেকের অনুমোদনের জটিলতায় কাজ দেরি হয়েছে।

প্রকল্পের কাজ নিয়ে স্থানীয় পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন খান্দার এলাকার বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন সোহাগ বলছেন, রাস্তাটা হলে চিকিৎসা নেয়ার জন্য খুবই সুবিধা হতো। রাস্তার পাশে কিছু প্রতিষ্ঠান হতো। সবাই এটা নিয়ে আশাবাদি ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই একটি কালভার্ট নিয়ে পৌরসভা ও এলজিইডির দ্বন্দ্বে কাজ বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান এ ব্যবসায়ী। স্থানীয় পৌর মেয়রও এখানে এসে প্রকৌশলীকে ডেকে নিয়ে কথা বলেছিলেন। এরপর থেকে বছরখনেক ধরে কাজ থেমে আছে। অধিগ্রহণও থেমে আছে বলে জানান তিনি।

যদিও বগুড়া পৌরসভার মেয়র মো. রেজাউল করিম বাদশা সড়ক বিভাগের সঙ্গে পৌরসভার দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করে, ওদের (প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের) ফান্ড নেই বলে মন্তব্য করেন। আর সে কারণে কাজ বন্ধ আছে বলে জানান। রাস্তার একাংশ পাকা হয়ে গেছে আর আরেক অংশের কাজ শুরুই হয়নি। ফলে মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল থেকে খান্দার পর্যন্ত কাজ না হওয়ায় রাস্তাটি ব্যবহার অনুপযোগী অবস্থায় পড়ে আছে। স্বস্তি মিলছে না চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের।

আরও পড়ুনঃ  জাল টাকা দিয়েই ভুক্তভোগীদের ঋণ শোধ করতেন সাহেদ

ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে সংশোধিত ডিপিপিতে নতুন ভূমিগ্রহণ নীতিমালা অনুযায়ী খরচ বাড়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি ২০১৮ সালের রেড শিডিউল অনুযায়ী প্রাক্কলন করা হলেও পরে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়। এর আগে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। যেখানে বলা হয়, এ সড়ক নির্মাণ হলে যানজট হ্রাস পাওয়ায় বছরে পরিবহন ব্যয় সাশ্রয় হবে ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকার। ফলে আয়-ব্যয় বিশ্লেষণে প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে মন্তব্য করা হয়।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ২.৫৮ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদান। সড়ক বাঁধে মাটির কাজ, ১৩ মিটার আরসিসি কালভার্ট নির্মাণ ও ৩ হাজার মিটার ড্রেন নির্মাণ। ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার নতুন পেভমেন্ট নির্মাণসহ সাইন সিগনাল ও গার্ডপোস্ট। প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথমে মাত্র আড়াই হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণে ৮১ কোটি ৫১ লাখ টাকা বরাদ্দের কথা বলা হলেও পরে ৮১ কোটি ৬২ লাখ টাকা যুক্ত করে মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ১৬৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। যেখানে মূল সড়ক নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

প্রধানমন্ত্রী একনেক সভায় বার বার সময়মতো কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেয়ার পরও প্রকল্পে মেয়াদ বাড়ায় ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে অপচয় হচ্ছে সরকারি অর্থের। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব (সদস্য) মো. মামুন-আল-রশীদ বলেন, নতুন ভূমি অধিগ্রহণ আইনে ৩ গুণ বেশি ক্ষতিপূরণ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ফলে নতুন করে সংশোধিত প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে বলেও জানান তিনি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন