রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাটেনি বিপদ আতঙ্ক

কাটেনি বিপদ আতঙ্ক

ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পরও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন। অগ্নিনির্বাপণে কাজ করে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা। ফায়ার সার্ভিস বলছে, জ্বলন্ত কনটেইনারগুলোর পাশে একটি কনটেইনারে রাসায়নিক থাকতে পারে। এ কারণে সতর্কতার সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে তারা। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন দপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত বিএম ডিপোর বিস্ফোরণে ৪৯ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও চিকিৎসকদের আশঙ্কা সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, কনটেইনার ডিপোটিতে ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড’ নামে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ; উচ্চতাপে এটি বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। এতে উদ্ধারকর্মীরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

এদিকে, বিস্ফোরণের ঘটনায় রাসায়নিক পদার্থ থাকা চারটি কনটেইনার চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে অপসারণের চেষ্টা চলছে। সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল এ তথ্য জানিয়েছেন। কর্নেল হিমেল বলেন, ডিপোতে থাকা চারটি কনটেইনারে রাসায়নিক পদার্থ থাকার বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এই কনটেইনারগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে অপসারণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে ঘটনাস্থলের আশপাশ এলাকা ও গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক এখনও কাটেনি। তারা অনেকেই আবারও বিস্ফোরণের আশঙ্কায় ঘরবাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন।

বিএম কন্টেনার ডিপোর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় এক হাজার কোটিরও বেশি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। অবশ্য বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডা ১৪শ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে। বিপুল পরিমাণ রপ্তানি পণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন কারখানার আমদানিকৃত বহু কাঁচামালও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

আগুন এবং বিস্ফোরণে কনটেইনার ডিপোর ভেতরে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মাঝে পণ্যভর্তি প্রায় ১২শ’ টিইইউএস কনটেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএম ডিপোতে থাকা পণ্যভর্তি দেড় হাজারেরও বেশি কনটেইনারের ৯৫ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো কনটেইনার দুমড়ে মুচড়ে একেবারে শেষ হয়ে গেছে।

আরও পড়ুনঃ  ‘এ প্লাস’ ক্রেডিট রেটিং এ বিডি ফাইনান্স

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। হল্যান্ডের সাথে যৌথ বিনিয়োগে ২০১১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা পরিচালনা করছে। প্রায় ২৫ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা বেসরকারি এই কনটেইনার ডিপোর ধারণক্ষমতা ৭ হাজার টিইইউএস কন্টেনার। এর মধ্যে ঘটনার সময় এই ডিপোতে ৪ হাজার ৩শ’ টিইইউএস কন্টেনার ছিল। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার টিইইউএস খালি কন্টেনার, যেগুলোতে পণ্য বোঝাই করা হতো। অপরদিকে, ১ হাজার ৩শ’ টিইইউএস কন্টেনার ছিল পণ্য ভর্তি। এর মধ্যে অধিকাংশ প্রায় ৫শ’ কন্টেনার ছিল আমদানি পণ্য বোঝাই এবং প্রায় ৮শ কন্টেনার ছিল রপ্তানি পণ্য বোঝাই।

বিএম কন্টেনার ডিপোর ম্যানেজার নাজমুল আকতার খান বলেছেন, পণ্যভর্তি কন্টেনারগুলোর মধ্যে ৪৫০টিতে আমদানি এবং আটশ কন্টেনারে রপ্তানি পণ্য ছিল। মূলত তৈরি পোশাক ও খাদ্যপণ্যই রপ্তানির জন্য কন্টেনারে বোঝাই করা হয়েছিল। দু’য়েকদিনের মধ্যে কন্টেনারগুলো জাহাজীকরণের প্রোগ্রাম ছিল। বেসরকারি কন্টেনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার সেক্রেটারি মোহাম্মদ রুহুল আমিন সিকদার বলেছেন, আমদানি রপ্তানি মিলে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়েছে। এর বাইরে কন্টেনার ডিপোর অন্তত ২শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এদিকে, বিজেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান, দেশের কমপক্ষে ৭০ জন রপ্তানিকারকের পোশাক ভর্তি কন্টেনার ছিল বিএম ডিপোতে। যেগুলো পুড়ে গেছে। তাছাড়া না পুড়লেও সেগুলো আর রপ্তানি করা যাবে না। এতে করে বিএম কন্টেনার ডিপোতে পুরোপুরি পুড়ে যাওয়া কিংবা আংশিক পোড়া কোনো কন্টেনারই আর বিদেশে পাঠানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, আমরা খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জেনেছি তাতে আমাদের বিভিন্ন সদস্য প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যভর্তি ৪০০ কন্টেনার পুড়ে গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ১৫ জন রপ্তানিকারকের পণ্য রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

আরও পড়ুনঃ  বাড়ছে ধরলা-ব্রহ্মপুত্রের পানি, বর্ষার শুরুতেই পানিবন্দি অর্ধলক্ষাধিক মানুষ

চট্টগ্রামের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলেন, শুধু চট্টগ্রামের রপ্তানিকারকদের ১৮ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি পণ্য ছিল ডিপোতে।
ঢাকাসহ সারাদেশের রপ্তানিকারকদের মোট কত টাকার পণ্য ছিল, সে তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি বলেও তিনি জানান।

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির প্রেক্ষিতে চলতি সপ্তাহে জাহাজীকরণের জন্য নির্ধারিত এসব পণ্যের শিপমেন্ট আর হচ্ছে না। এতে বিদেশি বায়ারদের সাথে আমাদের নতুন করে আলোচনা করতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এইচএন্ডএমসহ টিভিএইচ, টার্গেটসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য ছিল এসব কন্টেনারে। এ ছাড়া ডিএইচএল’র কিছু পণ্য ছিল। যেগুলো মূলত অনলাইন শপিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রয়াদেশের বিপরীতে পাঠানো হচ্ছিল। সবকিছু মিলে দেশের অনেক বড় একটি ক্ষতি হলো বলেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উল্লেখ করেন।

এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২৪ বছর আগে শুরু হয় বেসরকারি কন্টেনার ডিপো বা আইসিডি ব্যবসা। দেশের বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত রপ্তানি পণ্য ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যানে বোঝাই করে এখানে আনা হয়। পরে এখানে কন্টেনারে বোঝাই করে জাহাজীকরণের মাধ্যমে রপ্তানি করা হয়। দেশের শতভাগ রপ্তানি পণ্য এই প্রক্রিয়ায় জাহাজীকরণ করা হয়। বিএম কন্টেনার ডিপোসহ চট্টগ্রামে ১৬টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। এসব ডিপোতে শতভাগ রপ্তানি পণ্যের পাশাপাশি ৩৭ ধরনের আমদানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার এনে খালাস করা হয়। এতে করে কন্টেনার ডিপোতে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, কন্টেনার মুভারের আনাগোনা লেগে থাকে। ডিপোর নিজস্ব কর্মীবাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন যানবাহনের চালক সহকারীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীবাহিনী কাজ করে। ডিপোতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের সময় অন্তত ৫শ’ মানুষ ভেতরে নানা কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলেও সূত্র জানিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  জ্বালানির অভাবে অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ

অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৫ জনের মধ্যে ২২ জনের লাশ যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের পরিচয় শনাক্ত করতে স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু করেছে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্র থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আলাউদ্দিন তালুকদার বিষটি নিশ্চিত করে বলেন, আগুনে মৃত ২২ জনের লাশের সুরাতহাল করে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্যদিকে, যেসব মৃত ব্যাক্তির পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি, তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে এই কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তা প্রথমে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে প্রথমে আনা হয়। সেখানে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রপ্তানি পণ্য জাহাজে ওঠাতে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। গত শনিবার রাত ৮টার দিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোর লোডিং পয়েন্টের ভেতরে আগুনের সূত্রপাত হয়। কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে থাকলে, রাত পৌনে ১১টার দিকে এক কন্টেইনার থেকে অন্য কন্টেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কন্টেইনারে রাসায়নিক থাকায় একটি বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, স্থানীয় শ্রমিকসহ অনেকে আহত হন। নিহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন কর্মীসহ ৪৫ জন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ৫ কর্মী।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন