শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্নীতি বিস্তারে সহায়ক ‘অজ্ঞতা’

দুর্নীতি বিস্তারে সহায়ক ‘অজ্ঞতা’

দেশে এখন অন্যতম প্রধান সমস্যা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা। প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই দুর্নীতির বিস্তার। এটি প্রতিরোধের জন্য আইন জানা প্রয়োজন হলেও ৯৪.৩ শতাংশ মানুষের এ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। এ সম্প্রতি এক জরিপে এ তথ্য উঠে আসে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) এবং সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ (সিআইপিই) এর পরিবারভিত্তিক একটি জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপে জানানো হয়, ৪৪ শতাংশ উত্তরদাতা বর্তমান দুর্নীতির পর্যায়কে অগ্রহণযোগ্য, ৩৪ শতাংশ এটাকে গ্রহণযোগ্য এবং ২২ শতাংশ এ ব্যাপারে অনিশ্চিত। তাছাড়া কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে ১৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন পরিবার (মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ) এর প্রতি পরিবার থেকে কমপক্ষে একজন কর্মসংস্থান হারিয়েছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা প্রসঙ্গে সাতটি নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উত্তরদাতারা সেনাবাহিনীকে সবচেয়ে বেশি আস্থাভাজন হিসেবে পছন্দ করেছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলকে সবচেয়ে কম আস্থাশীল জায়গা হিসেবে দেখছেন। অধিকাংশ বাংলাদেশি নাগরিক যে কোনো প্রকার দুর্নীতির বিপক্ষে। কিন্তু অনেকেই এই বিষয়ে প্রশ্রয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। দুর্নীতির প্রতি অধিক সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী নাগরিকগণ সাধারণত দুর্নীতির শিকার হয়নি এবং গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে।

কোভিড-১৯ সমাজের দরিদ্র অংশকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং প্রতি চারটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার চাকরি হারানোর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারী দরিদ্রকে যেমন অধিক দরিদ্র করেছে, ধনী পরিবারসমূহ সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

জরিপটি পরিচালিত হয়েছে ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড দ্বারা। এতে কোভিড-১৯ মহামারীর পূর্বে এবং মহামারী চলাকালে দুর্নীতির উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে। পাশাপাশি এটা দেশের দুর্নীতির প্রকৃতি এবং এর ব্যাপকতা অনুসন্ধান করেছে।

আরও পড়ুনঃ  লবণ নীতিমালায় নতুন প্রত্যাশা

দুর্নীতিকে দেশের সর্বজনীন ব্যধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স (সিপিআই) অনুসারে সমসাময়িক বছরগুলোতে কিছুটা উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ উচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত। ২০২১ সালে ২৬ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১৪৭, যার অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরেই।

এই জরিপটি ২০২১ সালের ২৭ আগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে ১ হাজার ২৩১ জন জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বশীল প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে কম্পিউটার এসিস্টেড টেলিফোন ইন্টারভিউ পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। উত্তরদাতাদের যথেচ্ছভাবে রেসিলিয়েন্ট ডিসট্রিবিউটেড ডাটাসেটস পদ্ধতির মাধ্যমে বাছাই করা হয়।

জরিপের ফল অনুযায়ী, বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে দুর্নীতি দমন আইন বিষয়ক সচেতনতা মাত্র ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। যারা সচেতন তাদের মধ্যেও দুই-তৃতীয়াংশ এর বেশি বিশ্বাস করে যে বিদ্যমান আইনগুলোর মধ্যে এই অধিকারগুলোর চর্চা সম্ভব।

নাগরিকদের সাথে ঘটা দুর্নীতির বিভিন্ন ঘটনা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় সরকারি কার্যালয়ে অনেক বেশি বলে গণ্য করা হয়। এমন বিষয় থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা কর্তৃক নিয়োগকৃত তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ে বেশি তদন্ত করতে দেখা যায়।

দুর্নীতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব, বিশ্বাস এক প্রকার মিশ্র ধারণা নির্দেশ করে। ৪৪ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করে বর্তমান দুর্নীতির পর্যায় হলো অগ্রহণযোগ্য, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩৪ শতাংশ) এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করে এবং এক পঞ্চমাংশ এর কিছুটা বেশি (২২ শতাংশ) এ ব্যাপারে অনিশ্চিত।

‘কিছু প্রকার দুর্নীতি গ্রহণযোগ্য’ বিষয়ে জিজ্ঞাসা প্রসঙ্গে এর অগ্রহণযোগ্যতা গুরুতরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় দুই- তৃতীয়াংশ (৬২ শতাংশ) উত্তরদাতার মতে এটা অগ্রহণযোগ্য, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩১ শতাংশ) উত্তরদাতার মতে এটা গ্রহণযোগ্য এবং অল্প সংখ্যক উত্তরদাতা (৮ শতাংশ) এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয়।

আরও পড়ুনঃ  নিষিদ্ধ হচ্ছেন সাকিব

দুই-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি উত্তরদাতার অভিমত, অনুমোদনহীন সেবা, অর্থ উপহার, অথবা ঘুষ কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ উল্লেখ করেছে যে এটা সর্বদা বা মাঝেমধ্যে সমর্থনযোগ্য। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দুর্নীতিকে অনুমোদন করার পক্ষেই রয়েছেন।

দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায় হিসেবে তারা বলেন, এগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসচেতনতা তৈরি করা, আইন ও বিধিনিষেধ শক্তিশালী করা, কৌশল প্রয়োগ এবং শাস্তির বিধান জোরদার করা, জনপ্রশাসনের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করা, আইনের শাসনের ধারাবাহিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

জরিপটি কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব অনুসন্ধান করেছে। বিশেষ করে মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উপর। সেখানে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ২ দশমিক ১ মিলিয়ন পরিবারের (বাংলাদেশের মোট পরিবারের ৬ শতাংশ ) প্রতি পরিবারে কমপক্ষে একজন কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের মোট পরিবারের প্রায় অর্ধেক (৫১ শতাংশ) পরিবারের মধ্যে ন্যূনতম একজন ব্যক্তি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছে। যা প্রধানত সরকারি স্বাস্থ্যখাত থেকে এবং বাকিটা বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক, গ্রাম্য ডাক্তার ও ফার্মেসি থেকে।

কোভিড-১৯ মহামারী জাতীয় কর্মসংস্থান এবং পরিবারের আয়ের ওপর, বিশেষ করে দেশের নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে ১৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন পরিবার ( মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ) এর প্রতি পরিবার থেকে কমপক্ষে একজন কর্মসংস্থান হারিয়েছে। ফলশ্রুতিতে অনেক পরিবার, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবার তাদের আয়ের প্রাথমিক উৎস হারিয়েছেন।

আরও পড়ুনঃ  অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযানের পর ভুয়া ডাক্তারসহ আটক ৭

অপরদিকে সমাজের উচ্চ আয়ের পরিবারের অবস্থা মহামারীর পূর্বের মতোই রয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর এর মধ্যে প্রায় ৩ মিলিয়ন পরিবার সরকারি সহায়তা গ্রহণ করেছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা প্রসঙ্গে সাতটি নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উত্তরদাতারা সেনাবাহিনীকে সবচেয়ে বেশি আস্থাভাজন হিসেবে পছন্দ করেছেন। আস্থার ভিত্তিতে অন্যান্য নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের উচ্চ থেকে নিম্ন ক্রম হলো- আইন ও বিচার ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, ভূমি প্রশাসন/ রেজিস্ট্রেশন, স্থানীয় নেতাগণ এবং পুলিশ। উত্তরদাতারা রাজনৈতিক দলকে সবচেয়ে কম আস্থাশীল হিসেবে মতামত প্রদান করেছে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন