শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উদ্বেগ বাড়াচ্ছে মাংকিপক্স

উদ্বেগ বাড়াচ্ছে মাংকিপক্স

করোনা মহামারির মধ্যেই ইউরোপে মাংকিপক্স ভাইরাসে শনাক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েকদিনে যে হারে শনাক্ত হয়েছে, তা নিয়ে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, সামনে নতুন করে আরও সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হতে পারেন। রোগটি পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকায় সাধারণত সবচেয়ে বেশি দেখা গেলেও এবার সেই গণ্ডি পেরিয়েছে। বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশে ছড়িয়ে পড়া নতুন সংক্রমণ ‘মাঙ্কিপক্স’। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন সারাবিশ্ব।

ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০০ জনেরও বেশি মানুষের দেহে এই সংক্রমণ ধরা পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনেও মাংকিপক্স রোগী শনাক্ত। এটি আগে পশ্চিম আফ্রিকার মধ্যেই ছিল। হঠাৎ আফ্রিকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ায় স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না চিকিৎসকরা।

এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগ বিশেষজ্ঞ শার্লট হ্যামার বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে সামনে আরও শনাক্ত দেখতে যাচ্ছি। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সক্রিয়ভাবে সংক্রিমতদের খুঁজছেন। মাংকিপক্সের ইনকিউবেশনের সময়কাল এক থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে হয়ে থাকে। যারা প্রাদুর্ভাবের প্রথমদিকে আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের মধ্যে সংক্রমণ দেখতে পাবো।

মাংকিপক্স কি?
মাংকিপক্স একটি ভাইরাসজনিত অসুখ। স্মলপক্স ভাইরাস শ্রেণির একটি ভাইরাস এ রোগের জন্য দায়ী। ভাইরাসটির দু’টি রূপান্তরিত ধরন রয়েছে- মধ্য আফ্রিকান ও পশ্চিম আফ্রিকান। মাংকিপক্সের ইনকিউবেশনের সময়কাল এক থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে হয়ে থাকে।

রোগটির বিভিন্ন লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। প্রথম পর্যায়ে রোগীর জ্বর আসে, পাশাপাশি শরীরে দেখা দেয় ফোস্কা ও অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি ওঠে। পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে; বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে। এখন পর্যন্ত মাংকিপক্সে আক্রান্তদের নির্দিষ্ট ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি নেই।

আরও পড়ুনঃ  করোনা সংক্রমণ রোধে জনসমাগম নিষিদ্ধ সহ ১৮ নির্দেশনা

ভাইরাসটির দু’টি রূপান্তরিত ধরন রয়েছে— মধ্য আফ্রিকান ও পশ্চিম আফ্রিকান। পশ্চিম আফ্রিকান ভাইরাসের প্রজাতিটি মৃদু ধরনের; যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সনাক্ত হয়েছে। এই প্রজাতিতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার প্রায় ১ শতাংশ। বেশিরভাগ মানুষ দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিথ নিল বলেন, ভাইরাসটিকে আপাতত প্রাণঘাতী মনে হচ্ছে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক মার্টিন হির্সচ রয়টার্সকে বলেছেন, কোভিড-১৯ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি অত্যন্ত সংক্রামক। কিন্তু মাংকিপক্সে ক্ষেত্রে এমন ঘটবে না বলে মনে হচ্ছে।

১৯৭০ সালের পর থেকে আফ্রিকার ১১ দেশে মাংকিপক্স সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২০১৭ সালের পর নাইজেরিয়ায় এবার সবচেয়ে বেশি এ রোগের প্রকোপ দেখা গেছে। দেশটিতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের দেহে উপসর্গ দেখা গেলেও ১৫ জনের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

গত ৭ মে প্রথম একজন ইউরোপীয় নাগরিকের দেহে মাংকিপক্স শনাক্ত হয়। নাইজেরিয়া থেকে ওই ব্যক্তি ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছিলেন। এরপর থেকে আফ্রিকার বাইরে ১০০ জনের সংক্রমণ নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড একাডেমিক। শনাক্তদের বেশিরভাগের সঙ্গে আফ্রিকা ভ্রমণের ইতিহাস নেই। যে কারণে রোগের প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি অস্পষ্ট। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, সামাজিক সংস্পর্শ থেকে এটা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, চলমান প্রাদুর্ভাবে এখন পর্যন্ত মাংকিপক্স শনাক্তের ঘটনাগুলো কিছুটা অস্বাভাবিক। যেসব দেশে ভাইরাস নিয়মিত ছড়িয়ে পড়ে না, সেসব দেশে বর্তমানে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে। বর্তমানে শনাক্ত হওয়া এই ভাইরাসের উত্স এবং এর রূপ বদল ঘটেছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। ইউরোপ এবং অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলোতে আসন্ন গ্রীষ্মের উৎসব, পার্টি এবং ছুটির সময়ে লোকজন সমবেত হওয়ায় সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুনঃ  লোকসানের মুখে মাগুরার লিচু চাষিরা

মার্কিন সরকার বলছে, পুরো দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য স্ট্র্যাটেজিক ন্যাশনাল স্টকপাইলে (এসএনএস) গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনের যথেষ্ট মজুত আছে। এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, গুটিবসন্তের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রয়েছে; যা বিশেষ পরিস্থিতিতে মাঙ্কিপক্সের চিকিত্সায় ব্যবহার করা যেতে পারে।

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচেওয়ানের ভ্যাকসিন এবং সংক্রামক রোগ সংস্থার ভাইরোলজিস্ট অ্যাঞ্জেলা রাসমুসেন বলেছেন, ভাইরাসটি নতুন কিছু নয় এবং এটি প্রত্যাশিত। কয়েকটি সূত্র বলছে, বর্তমানে মাংকিপক্সের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হওয়া লোকজনের মাঝে— এমন অনেক পুরুষ আছেন, যারা পুরুষদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছেন। স্পেনের মাদ্রিদ অঞ্চলের সাউনার কয়েকটি ঘটনায় এ ধরনের শারীরিক সম্পর্কের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

সব বন্দরে স্বাস্থ্য সতর্কতা
এমন পরিস্থিতিতে নতুন এই সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশের প্রত্যেক বন্দরে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, এয়ারপোর্ট, ল্যান্ড পোর্টসহ সমস্ত পোস্টগুলোকে আমরা সতর্ক থাকতে বলেছি। সন্দেহভাজন কেউ আসলে যেন তাকে চিহ্নিত করা যায়। এছাড়া অতিদ্রুত যেন তাকে সংক্রমণ ব্যাধি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আতঙ্কিত না হওয়ার বিষয়ে ডা. নাজমুল বলেন, মাংকিপক্স নিয়ে আমাদের এতো প্যানিক (আতঙ্ক) হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা ভাইরাসটির সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা সারাবিশ্ব থেকেই তথ্য উপাত্ত নেব এবং প্রয়োজন অনুযায়ী যা ব্যবস্থা নেওয়ার সেটি আমরা করবো।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন