বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঈদে যাত্রীসেবায় পিছিয়ে দেশ

বিশ্বায়নের যুগে শহরায়নের বিস্ফোরণ ঘটেছে বিশ্বজুড়ে। শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন আর কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে যাওয়ায় গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এতে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই শহরায়নের গতি দিন দিন বাড়ছে। এক্ষেত্রে এশিয়ায় শহরায়নের মাত্রা আর বৈশিষ্ট্য অনেকটা ভিন্ন। কাজের খোঁজে শহরে আসা এশিয়ার মানুষের মধ্যে গ্রামে রেখে আসা প্রিয়জনের জন্য মনের বা নাড়ির টানের মাত্রা অনেক বেশি। বিভিন্ন উৎসব ঘিরে এই টান বেড়ে যায়। গ্রামে বা নিজ এলাকায় ফিরে প্রিয়জন বা স্বজনদের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে প্রধান দুই উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় কর্মস্থল থেকে নিজ গ্রামে বা এলাকায় ফেরার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এ তালিকার শীর্ষে থাকে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।

বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে উৎসব ঘিরে গ্রামে ও মফস্বলে থাকা আপনজনেরা অপেক্ষায় থাকেন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বা প্রবাসী প্রিয়জন কখন তাদের মাঝে ফিরবেন। সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন স্নেহ, মায়া, মমতা, উপহার আর সংসারের খরচ চালানোর প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে শহরায়নের বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে। কাজ, ভালো শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সন্ধানে গ্রাম বা মফস্বল থেকে লাখ লাখ মানুষ রাজধানীসহ শহরে এসে ভিড় করছেন। বড় কোনো উৎসবের ছুটিতে তারা কর্মস্থল ছেড়ে নিজ এলাকায় ফিরতে থাকেন। বিশেষ করে এক ঈদ ঘিরে অন্তত ৬০-৭০ লাখ মানুষ রাজধানী ছাড়েন। যাদের মধ্যে ৯০ ভাগ মানুষই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত।

তবে এশিয়ার অন্যদেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ঈদের মতো বড় উৎসব উপলক্ষ্যে ঘরে ফেরার ক্ষেত্রে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়। সড়ক, নদী ও রেলপথে তৈরি হয় ভয়াবহ যানজটের। অন্য সময়ের তুলনায় ভাড়াও বেড়ে যায় দ্বিগুণ, তিনগুণ। শুধু তাই নয়, সড়কে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। বাসে বা লঞ্চে অনেক সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ঈদের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। প্রাণ হারান বহু মানুষ। যদিও বিশ্বের বহু দেশেই বড় কোনো ধর্মীয় উৎসব ঘিরে কর্মস্থল থেকে নিজ এলাকায় ফেরার চিত্র দেখা যায়। তবে এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, ভারত, চীনের চিত্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়।

আরও পড়ুনঃ  র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার নতুন পরিচালক লে. কর্নেল খায়রুল

বিশেষত, এশিয়ার দ্বীপদেশখ্যাত মুসলিম অধ্যুষিত প্রায় ২১ কোটি জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় গত দুই বছরের করোনা মহামারি কাটিয়ে এবার সবচেয়ে বেশি ৮-৯ কোটি মানুষ ঈদ উৎসবে গ্রামে ফিরবেন। যাদের মধ্যে অন্তত দুই কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত। দেশের শীর্ষ সারির একটি প্রত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেয়া তথ্যমতে, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে দেশটির বিশেষ একটি শাখা মাস খানেক আগে থেকেই কাজ ‍শুরু করেছে। যাত্রী সেবায় ইতোমধ্যে মহাসড়ক, স্টেশন ও বন্দরে ১৪ হাজার জরুরি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখানোর মাধ্যমে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত প্রায় দুই কোটি মানুষকে জাহাজ, ট্রেন, বাসের টিকেট বিনামূল্যে সংগ্রহ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের জন্য ঈদযাত্রায় নিয়োজিত রয়েছে ১৫ হাজার বাস।

তবে ইন্দোনেশিয়ার বিপরীত চিত্রই দেখা যায় বাংলাদেশে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ঈদযাত্রা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। জীবিকার তাগিদে শহরে আসা নিম্নবিত্তদের ঈদে ঘরে ফিরে পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের মাশুল গুনতে হয়। টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি সাহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট মেলে না। মিললেও দ্বিগুণ, তিনগুণ দামে কিনতে হয়। জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা তো নেইই, অনেক সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেও পড়তে হয় বিপাকে। নিম্নবিত্তদের জন্য কোনো বাস বা পরিবহন নিয়োজিত করার কথা চিন্তাও করা যায় না।

গতকাল বৃহস্পতিবার ‘ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবিতে’ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী তথ্য দিয়েছেন, এবারের ঈদযাত্রায় সবমিলিয়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ভাড়ার মাশুল গুনতে হবে। যে টাকা চলে যাবে সিন্ডিকেটের পকেটে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে স্থল, নৌ, রেল কিংবা আকাশ- প্রতিটি পথেই গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। শ্রমিকদের ঈদের বেতন-বোনাস না দেয়ায় তারা সেই টাকা যাত্রীদের কাছ থেকেই ‍উঠানোর চেষ্টা করে।

আরও পড়ুনঃ  বাংলাদেশি ও ব্রিটিশদের জন্য ১০ মে বিমানের বিশেষ ফ্লাইট

তারা বলছেন, সড়ক পথে ৪০ কোটি ট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে ১০০ টাকা বাড়তি দিলেও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা এবং নৌ, রেল ও আকাশপথে ২০ কোটি ট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে ২০০ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হলেও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আদায় হবে।

প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ঈদযাত্রায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের ভাগ নিতে হয়। দিনের পর দিন ধরে এমনটা চলতে থাকলেও সঠিক তথ্য প্রাপ্তি ছাড়াই যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয় তা আসলে কাজে আসে না। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেব মতে, এবারের ঈদে ঢাকা থেকে এক কোটি ও আন্তঃজেলা থেকে ৫ কোটিসহ মোট ৬ কোটি মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যাবেন ঈদ উৎসব পালন করতে।

তবে বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশে ঈদ বা অন্যান্য উৎসবে কত মানুষ শহর থেকে গ্রামে যায়, এতে পরিবহনের তেলসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় কত তার কোনো জরিপ নেই। এমনকি ঈদযাত্রায় কত কোটি টাকার ব্যবসা হয় সে বিষয়েও কোনো তথ্য নেই। একই রকম বক্তব্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এনফোর্সমেন্টের পরিচালক মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের। তিনি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, পরিবহনখাতে ঈদ বা উৎসবকেন্দ্রিক যাতায়াতের আয়-ব্যয়ের কোনো জরিপ বা তথ্য আমাদের হাতেও নেই।

আসাদুল্লা লায়ন নামের এক তরুণ বললেন, আমাদের উন্নয়ন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শহরকেন্দ্রিক। ফলে সবাই শহরে এসে ভিড় করেন। এসব কাজ ও গুরুত্বপূর্ণ অফিস ভাগ করে দিলে ভিড় বা যানজট কমবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চল কিংবা উত্তরা থেকে যেসব কাজের জন্য বেশি লোক ঢাকায় আসে, তাদের সে কাজ সেই স্থানে দিলে কর্মসংস্থান যেমন হবে, তেমনি যানজটও কমতো। ঈদে যাত্রীসেবার মান আরো বাড়ানো যেত।

আরও পড়ুনঃ  শ্রেষ্ঠতের সম্মাননা পেলেন ৫ জয়িতা

প্রতিবেশী দেশ ভারতে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত মুসাদ্দেক মুন্না তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ভারতে ১২ মাসে ১৩ পার্বণ হলেও উৎসব ঘিরে মানুষ এতটা গ্রামমুখী নয়। অবশ্য ভারতের মুসলমানরা সাধারণত শহরের বাসিন্দা হওয়ায় ঈদে তেমন গ্রামমুখী হন না। অন্যদিকে, ভারতে কর্মসংস্থান বেশি পরিমাণে শহর কেন্দ্রিক না হওয়ায় বাংলাদেশের মতো হুড়মুড় করে গ্রামে ফেরার তাড়া থাকে না।

অন্যদিকে, সৌদি আরবে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছেন ইঞ্জিনিয়ার সাইদুল ইসলাম সুমন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো এখানে কর্মসংস্থান শহর কেন্দ্রিক নয়। প্রত্যেকেই প্রায় নিজের বাড়িতে বা শহরে থেকে কাজ করতে পারে। তাতে রাজধানী কেন্দ্রিক যাতায়াত কম হওয়ায় ঈদে বাড়ি ফেরার প্রবণতা কম।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কামরুল হাসান জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি স্টেটের আলাদা রাজধানী থাকে। যেখানে সব সরকারি অফিসের প্রধান কার্যালয় থাকে। যার শাখা অফিস থাকে অন্য শহরগুলোতে। যে কারণে রাজধানীর ওপর নির্ভর করতে হয় না। এখানে যোগাযোগ খুবই উন্নত। কোনো উৎসবে যাতায়াতে সমস্যা হয় না। তাছাড়া বাংলাদেশের মতো গ্রামে ও শহরে উভয় জায়গায় মানুষের বাড়িও থাকে না। চীনা নববর্ষে সবচেয়ে বেশি মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করেন। তবে বাংলাদেশের মতো এতটা দুর্ভোগের শিকার হতে হয় না।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন