রবিবার, ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভোগান্তি ঘিরে বাণিজ্য

ভোগান্তি ঘিরে বাণিজ্য

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘিরে দেশে ব্যাপক শহরায়নের ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে ঘটেছে পরিবর্তন ও বৈচিত্র। নির্দিষ্ট স্থানে বা এলাকায় আর সীমাবদ্ধ থাকছে না পেশা। বিশেষ করে কাজের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে পারি দেয়া মানুষের সংখ্যা গত কয়েক দশকে ব্যাপকহারে বেড়েছে। এতে রাজধানীসহ দেশের জেলা শহরগুলোতে জনসংখ্যার চাপে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। যদিও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণে কাজের সুযোগ বেড়ে যাওয়ায় শহরায়নের গতি দিন দিন বেড়েই চলেছে।

তবে এর মধ্যে বিগত দুই বছর করোনামহামারির ভয়াবহতার সময়ে চিত্রটা একেবারেই উল্টে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে যাওয়ায় কাজ হারিয়ে বহু মানুষ ফিরে গিয়েছিলেন গ্রামে। কোনো রকমে যুদ্ধ করেই জীবন কাটিয়েছেন তারা। তবে গত বছরের শেষের দিকে করোনার ভয়াবহতা খানিকটা কমে আসায় যারা শহর ছেড়েছিল তারা আবার শহরমুখী হয়েছে। শিল্প-কলকারখানা-ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা সচল হওয়ায় কর্ম হারানো মানুষ কাজে ফিরেছে। শহরাঞ্চলসহ সর্বত্র আবারো বেড়েছে কেনাকাটা, লেনদেন। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ উদ্যোক্তারা আবারো কর্মমুখর হয়েছে।

করোনা মহামারির সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্যে গত দুই বছর উৎসব থেকে দূরে সরি গিয়েছিল মানুষ। তবে করোনার সংক্রমণ খানিকটা কমে আসায় আবারো উৎসব ফিরেছে শহর থেকে গ্রামে। গত পহেলা বৈশাখে সীমিত আকারে হলেও উৎসবের আমেজ দেখা গেছে। এর মধ্যেই আবার ফিরছে প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসব। ইতোমধ্যে পবিত্র রমজান মাস ঘিরে পণ্যবাজার যেমন সরগরম তেমনি কেনাকাটাও বেড়েছে। আর কয়েকদিন পরেই ঈদ উৎসব। এই উৎসবকে ঘিরে দুই বছর পর আবার দৃশ্যপটের বদল ঘটেছে।

যারা কাজের জন্য শহরে এসেছিলেন তারা যথারীতি প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে যাচ্ছেন। একইভাবে যারা এক শহর থেকে অন্যশহরে কর্মসংস্থানের জন্য এসেছেন তারাও ফিরছেন নিজ শহরে। এভাবে এক রাজধানী মহানগরী থেকেই গ্রামে বা অন্য শহরে ফিরছেন প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ। লাখের হিসাবে যা ৬০ লাখের মতো। করোনা মহামারির আগের সময়েও এভাবে ঈদ উৎসব ঘরি ব্যাপক স্থানান্তর ঘটেছে মানুষের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার কোটি মানুষ রাজধানী ছাড়তে পারেন।

প্রতিবছর ঈদকে উপলক্ষ্য করে বিপুল সংখ্যক মানুষের শহর স্থানান্তরের ফলে ব্যাপকহারে চাপ পড়ে মূলত পরিবহনখাতের ওপর। সড়কের ধারন ক্ষমতার দিগুণ, তিনগুণ যানবাহন যাতায়াত করায় একদিকে যেমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় অন্যদিকে ভোগান্তি বাড়ে মানুষের। দীর্ঘদিন ধরে সড়ক সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকা আর বিপুল সংখ্য পরিবহনের চাপে যানজট সহনীয় মাত্রা ছেড়ে যায়। এতে যেমন ভোগান্তি ভয়াবহরকম ভাড়ে, তেমনি আবার পরিবহনবাণিজ্যের বড় দিকও খুঁজে পান এখাতের ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুনঃ  প্রায় ৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তেলর দাম

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, বহু কষ্টে উপর্জিত অর্থ ব্যয় করে আমাদের এখন ভোগান্তি কিনতে হয়। মানুষ প্রতিনিয়তই ভোগান্তি কিনতে টাকা খরচ করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থেকে একদিকে গচ্ছা দিতে হচ্ছে টাকা, অন্যদিকে বাড়ছে ভোগান্তি। দীর্ঘসময় গাড়িতে বসে থেকেও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না কেউই। পায়ে হাঁটা আধা ঘণ্টার পথও পাড়ি দেয়া যাচ্ছে না কয়েক ঘণ্টায়ও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাজের খোঁজে যে হারে মানুষ শহরে আসেন, সে হারে তাদের আবাসন ব্যবস্থা থাকে না। একইভাবে পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থাসহ থাকে না সড়কের ধারন ক্ষমতা। এতে ভোগান্তি চরম আকার ধারন করে। সারাবছর শহরে যে ভোগান্তি পোহাতে হয় সেই ভোগান্তির দেশব্যাপী সম্প্রসারণ ঘরে ঈদ উৎসব ঘিরে।

এবার ঈদে সবচেয়ে বড় ভোগান্তি টিকিট কাউন্টারে। বিশেষ করে ট্রেনের। টিকিট কেনার জন্য একদিন আগে থেকেই কাউন্টারে ভিড় করেছেন অনেকে। পরের দিনের টিকিট কিনতে আগের দিন রাত থেকেই লাইন ধরছেন তারা। রোজার সাহরি এবং ইফতারও করতে হচ্ছে রেলস্টেশনে বসেই। টাকা নিয়ে ভোগান্তি নামক টিকিট কিনতে লাইন ধরেও স্বপ্নের টিকিট পাচ্ছেন না অনেকে। অন্যদিকে নৌপথেও নেই স্বস্তিরৎ খবর। ঈদকে ঘিরে প্রতিবছরই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ঢল নামে এ পথে। তবে ঈদের আগেই শেষ হয়ে গেছে প্রায় সবগুলো লঞ্চের টিকিট। বাড়তি খরচ করেও টিকিট মিলছে না। লঞ্চ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদকে ঘিরে ভোগান্তির আশঙ্কায় আগেভগেই টিকিট শেষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ স্বস্তি নেই যাত্রাপথে।

বছরের পর বছর ধরে ঈদযাত্রাকে নিরাপদ আর সহজ করার যে উদ্যোগ নেয়া হয়ে আসছে, ঈদের আগে এসে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাস, লঞ্চ আর ট্রেনের টিকিট সংগ্রহে সীমাহীন ভোগান্তির পর যাত্রাকালে তার চেয়েও বড় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সারাদিন রোজা রেখে বেশিরভাগ সময় ইফতার করতে হচ্ছে গাড়িতে বসেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দীর্ঘদিনের সমস্যা যানজট। দিন যত যাচ্ছে এ সমস্যা ততই বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে আজ তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা। পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এখান থেকে উত্তরণ ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরে সারাবছর অসহনীয় যানজট লেগেই থাকছে। ছোট যানবাহন বাড়ছে, উল্টো কমছে বাসের সংখ্যা। গণপরিবহনে জোর দিতে বললেও তা উপেক্ষা করে আসছে সরকার। গণপরিবহনে জোর না দিয়ে ছোট গাড়িকে উৎসাহ দেওয়া সড়কে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়িয়ে তুলছে।

আরও পড়ুনঃ  ভারতে পাচার হচ্ছে কুকুর

রাজধানীর ভোগান্তির অভিজ্ঞতার পর ঘরে ফিরে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এবারও ঢাকা ছাড়ছেন লাখ লাখ মানুষ। ইতোমধ্যে লাখো মানুষের ঢল নামছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। টঙ্গী ব্রিজ থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশে ঈদযাত্রায় ভোগান্তি বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছে অনেকে। ঢাকা-গাজীপুর হয়ে ময়মনসিংহ সড়ক, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায়ও রয়েছে তীব্র ভোগান্তির শঙ্কা। পদ্মায় তীব্র নাব্য সংকট দেখা দেয়ায় এ সঙ্কট যে সহসা কাটছে না তা খুব সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। অর্থাৎ ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে সুখবর নেই।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও পরিবহন নেতাদের চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন টোল পয়েন্টের কারণে জাতীয় মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট হয়। এবারের ঈদে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ ও পরিবহন সংকট, করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাড়তি ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চালাতে কিছু কিছু পরিবহন মালিক-চালকরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভাড়া নৈরাজ্যকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কাগুজে বাঘের মতো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও দৃষ্টান্তমূলক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। যে কারণে ভোগান্তি আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

তবে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি হবে না জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলছেন, বিভিন্ন জায়গার সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় কাজ অসম্পন্ন রয়েছে। আমরা সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গার সংস্কার চলছিল। এ কাজ পরে শেষ করার কথা থাকলেও ঈদের জন্য বিবেচনা করে আগেই শেষ করা হয়েছে।

সুমন হোসেন নামে এক যুবক নিউস্কাটন এলাকার এক বাড়ি দেখাশুনার কাজ করছেন। গত রবিবার দুপুর আড়াইটার দিকে বাংলামটর থেকে বাসে করে সদরঘাটের উদ্যেশ্যে রওয়ানা দেন তিনি। সুমন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বাসার কাজ রেখে জরুরি কাজে সদরঘাটে যাবো বলে বের হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাসায় পৌঁছাতে পারবো কিন্তু তার আর হলো না। গুলিস্তান পর্যন্ত পৌঁছাতেই অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। এত জ্যাম এর আগে কখনো দেখিনি। আমাকে গুলিস্তানে গাড়িতে বসেই ইফতার করতে হয়েছে। হেঁটে গেলেও বাসায় এসে অন্ত ইফতার করতে পারতাম। গাড়িতে উঠে পড়েছি মহাবিপদে। ভোগান্তির এমন অভিজ্ঞতা শুধু সুমনের না। ঢাকার রাস্তায় চলাচল করা সকলের।

আরও পড়ুনঃ  ফ্ল্যাট কিনতে জামানত ছাড়াই ঋণ পাবেন নিম্নবিত্তরা

তাহিয়া রুবাইয়াত অপলা নামে এক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, অফিস শেষ করে বাসার পথে রওয়ানা হয়েছি তিনটার দিকে। আশাছিলো বাসায় গিয়ে ইফতার করবো। তবে ১৫ মিনিটের রাস্তা পার হতে সময় লেগেছে দুই ঘণ্টা। তবুও বাসায় পৌঁছাতে পারিনি। পিঁপড়ারাও যেন গাড়ির আগে চলে যেতে পারছে। এভাবে তিনটার সময় বের হয়ে সাড়ে ছয়টা ইফতার করতে হয়েছে রাস্তায় বসেই। অথচ স্বাভাবিক সময়ে বাসায় যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা। তিনি বলেন, জ্যাম থেকে বাঁচতে পাঠাও ভাড়া করেও স্বস্তি নেই। শুধু শুধু অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে। এটাকে জ্যাম বলা যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, জ্যাম হলে তো গাড়ি কিছুটা চলে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে এক যায়গায়ই গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আসাদুর রহমান মোল্লা বলেন, আমাদের রাস্তার উন্নয়নের সাথে সাথে অনওয়ে-টুওয়ে রাস্তার কম্বিনিশেন, আন্ডার পাস, ইউটার্ন নির্মাণ ও সিগনাল ব্যবস্থা কার্যকরী করার মাধ্যমে যানজট কমিয়ে আনা সম্ভব।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে সাড়ে ১২ হাজার ডলারে। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাল্টি ডাইমেনশনাল ইম্পেক্ট পড়বে। সবার গাড়ি ক্রয় করার সামর্থ্য হবে। আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকে তখন উপজেলাতেও ট্রাফিক জ্যাম হবে। ট্র্যাফিক জ্যাম নিরসন করা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। সমন্বিতভাবে কাজ করলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় গত তিন মাসে নিবন্ধিত হয়েছে ৪৩ হাজার ৬২১টি যানবাহন। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ও ছোট গাড়ি ৮ হাজার ৩৭৪টি। বাস ও মিনিবাস ৩৬২টি। এসময় সবচেয়ে বেশি ২৯ হাজার ১০৮টি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে। বিআরটিএর তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত মোটর যানের সংখ্যা ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬টি। এর মধ্যে প্রাইভেটকার ৩ লাখ ৮৫ হাজার, বাস ৪৯ হাজার ৬৭৩ এবং মোটর সাইকেল ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন