শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পানি সংকটে পাহাড়ি গ্রাম

পানি সংকটে পাহাড়ি গ্রাম

ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শেরপুরের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এলাকার টিউবওয়েলগুলোতে পানি মিলছে না। চাপ দিলে মাঝে মাঝে দু’এক ফোঁটা পানি বের হচ্ছে। বাধ্য হয়ে মানুষ রান্না ও থালা-বাসনসহ প্রতিদিনের কাজের জন্য এলাকার পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। এমনকি বিশুদ্ধ পানির অভাবে ঝরনা, পুকুর ও কুয়ার পানি পান করছেন এলাকাবাসী। ঝরনা ও কুয়ার পানি পান করে শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

ঝিনাইগাতীর পানবর, গুরুচরণ, দুধনই, গজনী, গান্ধিগাঁ, বৃষ্ণপুর ও শ্রীবরদীর বালিজুড়ি, খারামোড়া, হালুয়াহাটিসহ বিভিন্ন পাহাড়ি গ্রামগুলোতে প্রচুর পাথর থাকায় ও ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সাধারণ নলকূপে আর পানি উঠছে না। শ্রীবরদীর বালিজুড়ি ও হালুয়াহাটি এলাকার টিউবওয়েলগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। একমাত্র বিদ্যুৎচালিত গভীর সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে পানি উত্তোলন সম্ভব। যাতে এক থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করতে হয়। তবে সেই ব্যয় স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষে বহন করা কঠিন। সে কারণে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ করে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তীব্র পানিসংকট থাকে।

যদিও এলাকার সচ্ছল মানুষ ব্যক্তি মালিকানায় বিদ্যুৎচালিত গভীর সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে সেখান থেকে পানীয়সহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেন। আর সেসব গভীর পাম্প থেকে পানি নিতে আশপাশ এলাকার লোকজন জগ, বালতি, কলস আর বোতল নিয়ে ভিড় করেন। প্রতি বছর অন্তত ৫ থেকে ৬ মাস খাবার পানির তীব্র সংকটে দিন কাটে এখানকার বাসিন্দাদের। যদিও প্রতিবছরই তীব্র সংকট দেখা দিলে, গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যথারীতি সমাধানের আশ্বাস দেন। তবে শেষ অবধি সমাধান আর হয় না।

আরও পড়ুনঃ  একদিনে আক্রান্ত ৩৪৮০ মৃত্যু ৩৮

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবছর পাহাড়ি অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ময়লাযুক্ত পানি খেতে হয় তাদের। এতে নানা অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। এসব এলাকায় কয়েকটি করে সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে পানিসংকটের সমাধান করা যায় বলে জানান তারা।

রাণিশিমুল ইউনিয়নের বাসিন্দা রমজান আলী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ‘আমি ধানক্ষেতে পানি দিতে একটি বিদ্যুৎচালিত সাবমারসিবল পাম্প বসিয়েছি। বোরো মৌসুমে এই এলাকায় কোনো টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। তখন আমার পাম্প থেকেই এলাকার মানুষ পানি নিয়ে যায়। মেশিন চালু করলেও সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এতে তাদেরও অনেক কষ্ট হয়, আমারও অসুবিধা হয়।

হালুয়াহাটি গ্রামের বাসিন্দা রেজুয়ান বলেন, ‘আমগর এইদিকে পানি থাকে না বোরো মৌসুমে। পানি নিচে চলে যায়। প্রতিবছর এমন সমস্যা হলেও সরকার নজর দেয় না। আমরা যে পানির জন্য কত কষ্ট করি, কত ময়লা পানি খাইতেছি। আর এতে বিশেষ করে শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়ে রেজুয়ান বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে সাবমারসিবল পাম্প বসাতে হবে। আরেক বাসিন্দা হযরত মিয়া বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। এতো ট্যাহা নাই যে সাবমারসিবল পাম্প বসামু। কত যে কষ্ট করি পানির জন্য। আমগর বাড়ির একটু দূরে একজন পাম্প বসাইছে। সেখানে থেকে বালতি ভরে ভ্যান গাড়ি দিয়ে পানি আনি।’

ঝিনাইগাতীর বৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল জলিল মিয়া বলেন, হুনি সরকার কতো কিছুই দিতাছে। আমাগরে খালি কলই দেয় না। কয়ডা কল হলে এইখানে পানির আর কষ্ট থাকতো না’। আরেক বাসিন্দা রেহেনা আক্তার বলেন, ‘অনেকদিন থেকে আমরা রান্না ও খাওয়ার জন্য অন্য বাড়ি থেকে পানি টেনে টেনে নিয়ে আসি। খুব কষ্ট হয় পানি আনতে।’

আরও পড়ুনঃ  চলতি বছর নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা

ঝিনাইগাতীর পানবর এলাকার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া লামিয়া বলেন, ‘আমগর কলে পানি আহে না। আমি পুকুরে গোসল করি। আর আম্মা পানি আগুন দিয়ে ফুটায়া দেয়, ওই পানি খাই। অনেক সময় দেহা যায়, আম্মা ব্যস্ত থাহে ওই সময়ে ঘরে যে পানি থাহে অইডাই খাই।’

শ্রীবরদীর খারামোড়া গ্রামের আরেক শিশু জান্নাত আরা বলেন, ‘পানি বারাই না কল থনে। আম্মা মেলা দূর থনে পানি নিয়ে আহে। আম্মার মেলা কষ্ট হয়। তাই আঙগর উনু এডা কল চাই। দরিকালিনগর, সারিকালিনগর, প্রতাবনগরের ভুক্তভোগী বহু লোকজনের দাবি সাবমারসিবল পাম্পের। তারা বলেন, ‘গরিবের সব বিষয়েই কষ্ট! পানির অভাবে পুকুরের পচা পানিতে গোসল করতে বাধ্য হই। এই ভোগান্তি অবসানে সাবমারসিবল পাম্প দরকার। কিন্তু এত টাকা পামু কই?

দরিকালিনগরের শামসুল হক ও জামাল উদ্দিন সরকার, প্রতাবনগরের শতবর্ষী ডা. আব্দুল বারী ও রেজায়ুর রহমান মাস্টার বলেন, ‘এই মৌসুমে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। এতে খুব কষ্ট করে পানি যোগাতে হয়’।

পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মেরাজ উদ্দিন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, পাহাড়ি নদীগুলো নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে। নদী যেন দখল না হয় সেজন্য তদারকি করতে হবে। আর বর্ষা মৌসুমে বাড়ির আঙিনায় বা আশপাশের জলাধারগুলোতে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে’।

শ্রীবরদী উপজেলা চেয়ারম্যান এ ডি এম শহিদুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ‘শ্রীবরদীর সীমান্তে কয়েকটি গ্রামের পানির সংকট আছে। গত বছর কয়েকটি সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে। আরও পাম্প বসানো হবে সেজন্য কাজ করা চলছে। শিগগিরই পানির সঙ্কট থেকে সমাধান হবে আশা করি।’

আরও পড়ুনঃ  বাবার শ্রাদ্ধ শেষে ফেরার পথে প্রাণ হলেন চার ভাই

ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আব্দুল্লাহেল ওয়ারেজ নাইম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ‘ঝিনাইগাতীর বেশ কয়েকটি গ্রামে শুষ্ক মৌসুমে নলকূপে পানি ওঠে না। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু কিছু জায়গায় সাবমারসিবল পাম্প বসাচ্ছি। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে চাহিদা পাঠিয়েছি। আশা করছি, খুব শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে।’

শেরপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ছামিউল হক দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ‘সীমান্তে পাহাড়ি এলাকায় পানি সংকট নিরসনে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। যাতে সাধারণ মানুষ বিশুদ্ধ পানি খেতে পারে। এজন্য ইতোমধ্যে কয়েকটা গভীর পাম্প বসানো হয়েছে।

নির্বাহী প্রকৌশলী ছামিউল হক আরো বলেন, যেসব এলাকায় বেশি পানির সমস্যা, সেসব এলাকায় বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে গভীর নলকূপ ও সাবমারসিবল পাম্প বসানো হবে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আরও বরাদ্দ চেয়েছি। বরাদ্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সব গ্রামেই পাম্প বসানো হবে। এতে ওইসব এলাকার পানির সংকট দূর হবে।’

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন