শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্যাসের মজুদে টান

গ্যাসের মজুদে টান

গ্যাসের মজুদ বিবেচনায় বিশ্বের ৪৩তম হয়েও বাংলাদেশে জ্বালানি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। গত ৩ এপ্রিল হঠাৎ গ্যাসের অনুপস্থিতি সবাইকে বিপাকে ফেলে দেয়। এতে স্থবির হয়ে পড়ে জীবনযাত্রাসহ কলকারাখানার উৎপাদন। বর্তমানে বিদ্যুৎ, সার, কৃষি, কলকারখানা, খাদ্রসামগ্রী, উৎপাদন থেকে শুরু করে সবকিছুই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে গ্যাসের ওপর। দেশে দিনে যেখানে চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট, সেখানে গড়ে সরবরাহ হচ্ছে ২৮০ কোটি ঘনফুট। তাতে প্রতিদিন ঘাটতি হচ্ছে ৯০ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩১টি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রের ২৮টি থেকে উত্তোলন হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ ৯ হাজার ৯০১ বিলিয়ন ঘনফুট বা ৯ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের (টিসিএফ) কিছু বেশি। এর মধ্যে উৎপাদনে থাকা ২০ গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ রয়েছে ৮ দশমিক ৭৫ টিসিএফ গ্যাস। বাকি গ্যাসের মজুদ রয়েছে উৎপাদনে না থাকা সাত গ্যাসক্ষেত্রে, যার পরিমাণ এক টিসিএফের কিছু বেশি।

১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পর গ্যাস এখন নিত্যসামগ্রী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র হলো তিতাস। ১৯৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এটি আবিষ্কার করে পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি। প্রথম গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। সর্বশেষ গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় ২০২১ সালে সিলেটের জকিগঞ্জে।

ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের তৈরি স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ অব ওয়ার্ল্ড এনার্জি এবং ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) উপাত্তের ভিত্তিতে ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডটইনফো জানায়, মজুদ গ্যাসের বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৩তম। বিশ্বের মোট মজুদের দশমিক ১২ শতাংশ রয়েছে এখানে। সর্বোচ্চ গ্যাস মজুদ রয়েছে রাশিয়ায়, দ্বিতীয় ইরান, তৃতীয় কাতার। আবিষ্কৃত মজুদের ৬৪.১ শতাংশই রয়েছে এই তিনটি দেশের হাতে।

আরও পড়ুনঃ  ঝালকাঠিতে কালেক্টরেট সহকারী সমিতির পূর্ন দিবস কর্মবিরতি

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা এক টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। এর বিপরীতে গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় প্রাকৃতিক গ্যাসের মোট মজুদ ১০ টিসিএফের (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) কিছু কম। তবে এর পুরোটাই উত্তোলনযোগ্য নয়। যেকোনো গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ করা গ্যাসের সর্বোচ্চ ৭০-৭৫ শতাংশ উত্তোলন করা যায়। তাতে দেশে এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ টিসিএফ। বার্ষিক চাহিদা বিবেচনায় এ মজুদ দিয়ে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা যাবে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত বছর পর্যন্ত।

ভূতাত্ত্বিক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একটি গ্যাসকূপ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা যায়। তবে বাংলাদেশের গ্যাসকূপগুলো অনেক পুরনো। অঞ্চলভেদে এসব কূপ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। সে হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে সাড়ে ৭ টিসিএফের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা প্রায় অসম্ভব।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম জানান, গ্যাসের উত্তোলনযোগ্যতা নির্ভর করে গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ, গ্যাসের চাপ ও কূপের ওপর। এ অনুযায়ী একটি গ্যাসক্ষেত্রে মোট রিজার্ভের ৭০-৮০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। চাপ দিয়ে এর চেয়ে বেশি গ্যাস তুলতে গেলে সেখানে পানি চলে আসে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত উত্তোলন করা যেতে পারে।

পাঁচ বছর আগেও দেশে গ্যাসের দৈনিক উত্তোলন ছিল ২৮০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশীয় কূপগুলো থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। এর সঙ্গে সরবরাহ হচ্ছে আরো ৭৮ কোটি ঘনফুট এলএনজি। বঙ্গোপসাগরের গভীর-অগভীর অংশে ব্লকগুলোয় দুই দশক ধরে কোনো ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

আরও পড়ুনঃ  ‘লক্ষ্মী’ রুপের অলংকার

দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গোপসাগরের অফশোর ও অনশোরে (গভীর ও অগভীর) অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক। এসব ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে না থাকায় বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করা যায়নি।

ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্যমতে, রাশিয়ার মাটির নিচেই রয়েছে বিশ্বের ২৪.৩ শতাংশ গ্যাসের মজুদ। দেশটিতে মোট মজুদের পরিমাণ রয়েছে এক হাজার ৬৬৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। ইরানে ১৭.৩ শতাংশ সমান এক হাজার ২০১ টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র কাতারের হাতে রয়েছে ৮৭১ টিসিএফ গ্যাস। এই তালিকায় সমর শক্তিধর আমেরিকার অবস্থান চতুর্থ। বিশ্ব মজুদের ৫.৩ শতাংশ মজুদ রয়েছে দেশটির হাতে। দেশটিতে গ্যাস মজুদ রয়েছে ৩৬৮ টিসিএফ। এরপরই রয়েছে ইসলামের তীর্থস্থান রয়েল সৌদির অবস্থান। ২৯৪ টিসিএস।

প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ তুর্কমেনিস্তান ২৬৫, সংযুক্ত আরব আমিরাত ২১৫ ও ভেনিজুয়েলা ১৯৭ টিসিএফ। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন রয়েছে দশম স্থানে, ১৬৩ টিসিএফ মজুদ নিয়ে। আর ২২তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। তাদের মোট মজুদ ৫০ টিসিএফ। ৩০তম স্থানে থাকা পাকিস্তানের রিজার্ভ রয়েছে ২৪ টিসিএফের মতো।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ১৯১০ সালে প্রথম তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কূপ খনন করা হয়। প্রথম কূপটি খনন করা হয় সীতাকুণ্ডে। ১৯৫৯ সালে জুলাই মাসে প্রথম গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়। শুরু থেকে আশির দশক পর্যন্ত মূল লক্ষ্য ছিল তেল অনুসন্ধান। যে কারণে কুতুবদিয়াসহ (সাগরে) অনেক এলাকায় গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেলেও তা এড়িয়ে যায় তৎকালীন আইওসিগুলো। পরে ধীরে ধীরে গ্যাসে আগ্রহ বাড়তে থাকে।

আরও পড়ুনঃ  হোটেলবয় যখন রোবট

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ৯৫টি অনুসন্ধান কূপের মাধ্যমে ২৮টি গ্যাসফিল্ড আবিষ্কৃত হয়। এতে মোট মজুদ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) আবিষ্কৃার হয় ২৮.২৯ টিসিএফ। ২০টি গ্যাসফিন্ড থেকে ১০৬টি কূপ দিয়ে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ১৮.২৪ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়। অবশিষ্ট মজুদের পরিমাণ রয়েছে প্রায় ১০ টিসিএফ। বর্তমানে দৈনিক কমবেশি দুই হাজার ৬০০ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী নতুন আবিষ্কার না হলে ২০৩০ সাল নাগাদ মজুদ ফুরিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) ও পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে দেশে সর্বনিম্ন ৮.৪, গড় ৩২.১ ও সর্বোচ্চ ৬৫.৭ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে শুধু অনুসন্ধানে স্থবিরতার কারণে বাংলাদেশ মজুদে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন