বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বজ্রপাতের বড় ঝুঁকি

বজ্রপাতের বড় ঝুঁকি

ঘটনাটা গেল বছরের ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পদ্মানদীর তেলিখাড়ি ঘাট এলাকায়। বেশ আনন্দঘন একটা পরিবেশ ছিল। চাঁপাই সদরের জনতারহাট ডাইলপাড়া গ্রাম থেকে একদল বরযাত্রী নৌকায় করে তেলিখাড়ি গ্রামে যাচ্ছিলেন। পথে বৃষ্টি শুরু হয়। বরযাত্রীরা তেলিখাড়ি ঘাটে নৌকা ভেড়ান। সবাই গিয়ে আশ্রয় নেন ঘাটের ছাউনির নিচে। সবাই হাসি-তামাশায় মেতে উঠেছিলেন। এসব আনন্দঘন পরিবেশে হঠাৎ দানব হয়ে দেখা দেয় বজ্রপাত। মুহূর্তেই আনন্দ-উল্লাস চরম বিষাদে রূপ নেয়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান বরযাত্রীদের ১৭ জন। আহত হন আরো ছয়জন।

ভয়াবহ সেই ঘটনার কয়েকদিন পর ২৩ আগস্ট দিনাজপুর সদর উপজেলার ৮ নম্বর উপশহরে বৃষ্টির মধ্যে খেলতে গিয়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারায় চার কিশোর। একইদিনে চিরিরবন্দর উপজেলায় একসঙ্গে তিন যুবক মারা যান বজ্রপাতে। গত বছরে বজ্রপাতে দেশে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৩২৯ জন। প্রতিবছর এভাবে শত শত মানুষের প্রাণ কাড়ছে বজ্রপাত। গেল কয়েক বছরে বজ্রপাত প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাণহানিও বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। এক সময় গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে শুধু বজ্রপাত বেশি হতো, প্রাণও কাড়তো। তবে এখন আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসেও প্রাণহানি ঘটছে বজ্রপাতে।

সূত্রমতে, গেল ১১ বছরে (২০১০ থেকে ২০২১) দেশে বজ্রপাতে মোট প্রাণহানি ঘটেছে ২ হাজার ৮০০ জনের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে প্রাণহানি উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। প্রতি বছরই দেশে কয়েক শত মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। চলতি বছর বজ্রপাতের মৌসুম শুরু হতে চলেছে। প্রাণহানি এড়াতে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুনঃ  বিজ্ঞান মনস্ক জাতি গড়ে তুলতে হবে: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী

ফিনল্যান্ডের বজ্রপাত-বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘ভাইসালা’র গবেষকরা বলছেন, দিন দিন বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন-জঙ্গল উজাড়, বঙ্গোপসাগর থেকে সক্রিয় মৌসুমি বায়ু প্রবাহ, উত্তরের হিমালয়ের পাদদেশে পুঞ্জীভূত মেঘ, মেঘ সৃষ্টির প্রক্রিয়া কিউমোলোনিম্বাস (পুঞ্জমেঘ), মোবাইল ফোন টাওয়ার থেকে উৎপন্ন অতিমাত্রার ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও ওয়েব বজ্রপাতের জন্য দায়ী। দেশে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ বা তার বেশি-সংখ্যক বজ্রপাত মেঘ থেকে ভূমিতে নেমে আসে।

দেশে দিনে দিনে বজ্রপাতে প্রাণহানীর ঝুঁকি বাড়ায় সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ‘লাইটার অ্যারেস্টার’ সংবলিত বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি (শেল্টার) নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের হাওরাঞ্চলসহ বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় এসব ছাউনি নির্মাণে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তথ্যমতে, দেশের ২০১১ সালের পর থেকে বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রবণতা ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে। ২০১৫ সালে ৯৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৫১, ২০১৭ সালে ২৬২, ২০১৮ সালে ৩৫৯, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন। এছাড়া ২০২০ সালে বজ্রপাতে মারা গেছে ৩৮০ জন।

দেশে যেসময় বজ্রপাত হয় ওই সময় মাঠে প্রচুর কৃষি কাজ থাকে। কৃষকরা মাঠে থাকেন। সে কারণে বজ্রপাতের বেশি শিকার শ্রমিকরা হয়ে থাকেন। গবেষণা সংস্থা ভাইসালার তথ্য মতে, দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭০ শতাংশ ঘটনা ঘটে মাঠে-ঘাটে কৃষিকাজ করার সময়। এ ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে সাড়ে ১৪ শতাংশ এবং গোসল করা ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

আরও পড়ুনঃ  ট্রেনে খাবারের দাম বেশি নিলেই বাতিল হবে লাইসেন্স

সম্প্রতি এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগ আয়োজিত ‘আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড আর্লি অ্যাকশন: লাইটেনিং ডিজাস্টার’ শীর্ষক সেমিনারে এ তথ্য দিয়েছেন ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, বজ্রপাত ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে এতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সরকার তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এর একটি হলো আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম। অর্থাৎ বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগেই সংকেত দেবে সেই যন্ত্র। দ্বিতীয়ত, বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের শেল্টার নির্মাণ করা হবে। আর তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বাড়ানো হবে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা মতে, আমাদের প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৫০টি বজ্রপাত হয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। তাই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল এ অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই বেশি বজ্রপাত হয়। কেননা, এই অঞ্চলে বজ্রমেঘের সৃষ্টিই হয় বেশি। বজ্রমেঘ বেশি তৈরি হওয়ার কারণও প্রাকৃতিক। পৃথিবীর আদিকাল থেকেই বজ্রপাত ছিল। তবে মৃত্যুর হার সম্প্রতি বেড়েছে বলেই মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সধারণ সম্পাদক জামাত খান জানান, নিজেরা সচেতন হলে এ প্রাণনাশ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। আমাদের সতর্ককরণ বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে। আকাশে মেঘ করলে নিরাপদ জায়গায় চলে আসতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন