শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অর্থনৈতিক মূল্য অপরিসীম

অর্থনৈতিক মূল্য অপরিসীম

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ–

  • বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বড় মাইলফলক বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তা: ড. আতিউর রহমান
  • বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অর্থনৈতিক মূল্য নিরূপণে গবেষণার সময় এসেছে: ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সোপান। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সামগ্রিক এক দিকনির্দেশনা। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়েই বাঙালিরা পরিণত হয়েছিল অকুতোভয় সৈনিকে। অসীম সাহসিকতায় ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা।

মূলত, পাকিস্তানের সাড়ে ২৩ বছরের শাসন শোষণের ইতিহাসে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রপরিচালকরা বাঙালিকে রাজনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত করেছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের পিছিয়ে দিতে প্রতিবছর আয় কমিয়ে দিচ্ছিল তারা। পর্যায়ক্রমে যা দুই তৃতীয়াংশে নামিয়ে এনেছিল। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

‘যুদ্ধ দলিল: বাংলাদেশ কেন’ বইয়ে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী, সে সময় পাকিস্তানের গড় বার্ষিক বাজেটে সামরিকখাতে ব্যয় করা হতো ৬০ শতাংশ। যার মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে বরাদ্দ ছিল ৫০ শতাংশ। অথচ পূর্বপাকিস্তানে ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। আবার পাকিস্তানের অর্জিত মোট রাজস্বের ৬০ শতাংশই পূর্বপাকিস্তান থেকে আয় করা হতো। অথচ সেখানে ব্যয় করা হতো মাত্র ২৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে পূর্বপাকিস্তান থেকে অর্জিত রাজস্বের ৭৫ শতাংশ ব্যয় করতে নিয়ে যাওয়া হতো পশ্চিম পাকিস্তানে।

আরও পড়ুনঃ  সিদ্ধিরগঞ্জে রেলওয়ের জায়গা উচ্ছেদ বন্ধে মানববন্ধন

আবর বৈদেশিক বাণিজ্য ও আমদানি-রপ্তানিতেও সিংগভাগ আয় আসতো পূর্বপাকিস্তান থেকে। যেখানে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে পশ্চিম পাকিস্তান রপ্তানি আয় করতো ৮২০ মিলিয়ন ইউরো। যা শতকরা হিসাবে ৪১ শতাংশ। সেখানে পূর্বপাকিস্তানের আয় ছিল ১১৫৩ মিলিয়ন ইউরো। শতকরা হিসাবে যা ছিল ৫৯ শতাংশ। আবার পশ্চিম পাকিস্তানে আমদানি আয় ছিল ২৩১৫ মিলিয়ন ইউরোর সমপরিমাণ। যা শতকরা হিসাবে ৭০ শতাংশ। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তান আমদানি থেকে আয় করতো ১০০০ মিলিয়ন ইউরো। শতকরা হিসাবে মাত্র ৩০ শতাংশ।

শুধু রাজস্ব কিংবা আমদানি রপ্তানি আয়েই চরম বৈষম্য ছিল না, পাশাপাশি আন্তঃপ্রদেশ বাণিজ্যেও ছিল বিশাল ব্যবধান। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে রপ্তানি ছিল ৫২৯২ মিলিয়ন টাকার পণ্য। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি ছিল ৩১৭৪ ইউরো টাকার পণ্য। উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৈষম্য ছিল আকাশ-পাতাল।

বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থ ব্যয় পশ্চিম পাকিস্তানে ৮০ শতাংশ হলেও পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে ছিল ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বৈষম্য হয়েছে বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে।

বিদেশ থেকে সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যেত, তার ৯৬ শতাংশই ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। শিল্প-অর্থবিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে ব্যয় হতো ৮০ ভাগ, পূর্ব পাকিস্তানে তা কমে গিয়ে দাঁড়াতো ২০ ভাগে। আরো বড় বৈষম্য ছিল বাড়ি/সরকারি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে। এখাতে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো ৮৮ শতাংশ। যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়তো মাত্র ১২ শতাংশ।

আরও পড়ুনঃ  চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে সাড়ে ৩ ঘণ্টা আটকে ছিলো ট্রেন

পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক নীতি তথা অর্থনৈতিক শাসন- শোষণের কবল থেকে মুক্তি পেতেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিল লাখ লাখ বাঙালি। আর সেই মুক্তির নেশা জোরালো হয়েছিল একাত্তরে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে। সেই ভাষণে মূলত বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সামগ্রিক অর্থনৈতিক করুণ চিত্রই বেশি তুলে ধরেছিলেন। সেখান থেকে মুক্তির উপায়ও বাতলে দিয়েছিলেন। সে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের অর্থনৈতিক মূল্য ছিল অপরিসীম।

রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অর্থনৈতিক দিক তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার ড. আতিউর রহমান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সোপান। কেননা বঙ্গবন্ধু তখন অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন। সেখানে ৩৫টি নির্দেশনা জারি করে কার্যত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে রাষ্ট্রপরিচালনা করছিলেন। পাকিস্তান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে (বাংলাদেশ) শোষণ করছিল। এই ভাষণটি গভীরভাবে অধ্যায়ন করলে দেখা যায়, অর্থনীতির কি সুন্দর দিকনির্দেশনা তিনি দিয়েছেন। যেমন, ব্যাংক কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত চলবে। অফিস-আদালত কীভাবে চলবে। শ্রমিক ও চাকরিজীবীদের বেতন কীভাবে দিতে হবে- তা সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন।

ড. আতিউর রহমান আরো বলেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বড় মাইলফলক হলো বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তা। কেননা পাকিস্তান আমলে পর্যায়ক্রমে বাঙালিদের মাথা পিছু আয় কমছিল। এমনকি সেটা দুই তৃতীয়াংশে নিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৩ মার্কিন ডলার। সেটি ১৯৭৪ সালে ২৭৩ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেন। পক্ষান্তরে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর ১৯৭৬ সালে তা ২২৮ ও ১৯৭৭ সালে তা ১২৮ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুই দেশের প্রথম বাজেট দেন ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে। এরপর ১৯৭৪ সালে দেশের মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, মতান্তরে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এরপর আর কোনো বছরই জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়নি। আর তিনি প্রথম যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করেন তাতে কৃষিতে ২৪ ও শিল্পে ২২ শতাংশ বিনিয়োগ নির্ধারণ করেন।

আরও পড়ুনঃ  জয়পুরহাটে নানা কর্মসূচিতে বিশ্ব মা দিবস পালিত হচ্ছে

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অর্থনৈতিক মূল্য নিরূপণ করতে গিয়ে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্ট ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম আনন্দবাজারকে বলেন, পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে শুরু করে রাজস্ব আয় সবদিকেই আমরা এগিয়ে ছিলাম। তবে ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমাদের পেছনে রাখা হয়েছিল। অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সেই বঞ্চনা আমাদের স্বাধীনতার পথে পা বাড়াতে বাধ্য করেছে।

ড. আজিজুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন দেখলেন সব দিক দিয়েই বাঙালিদের পেছনে নিতে পশ্চিম পাকিস্তান ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে তখন তিনি ৬ দফায় ঘোষণা করে রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিকেও সামনে নিয়ে আসেন। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সার্বিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বিষয়টি রাজনৈতিক হলেও এর অর্থনৈতিক মূল্য অপরিসিম। এ বিষয়ে চিন্তা বা গবেষণার সময় এসেছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন