শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বেঁচে ফিরেছেন তারা

বেঁচে ফিরেছেন তারা

বেঁচে ফেরা ইউসুফ মৃধা জানান, আমি একাই একজনের শার্টের কলার, আরেকজনের মাফলার ও দুই হাতে আরও দুইজনসহ মোট চারজনকে ভাসিয়ে রেখেছিলাম। প্রচণ্ড ঠান্ডায় এদের মধ্যে একজনের মুত্যু হলে আমি হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এভাবে এক এক করে সবাই ডুবে যাচ্ছিলেন, কেউ ভেসে যাচ্ছিলেন সাগরের জলে। নিজেরা বাঁচব নাকি অন্যদের বাঁচাব এ ভেবেই সময়গুলো একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল।

চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে স্পিডবোটে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাচ্ছিলেন অভিবাসন প্রত্যাশী ৩৫ জন বাংলাদেশি। ইতালি পৌঁছানৌর ঘণ্টাখানেক আগে মাল্টা সীমানার জলরাশিতে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই স্পিডবোটটি উল্টে গেলে এর সব যাত্রী ডুবে যান। প্রচন্ড ঠান্ডায় ভেসে থাকার ১১ ঘণ্টা পর কোস্টগার্ডের সদস্যরা উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করা জীবিত ৭ জনকে উদ্ধার করে। তবে তীরে পৌঁছার আগেই ঠান্ডায় জমে একজনের মৃত্যু হয়। ঘটনার ৩৬ দিন পেরিয়ে গেলেও ভূমধ্যসাগরে এখনো নিখোঁজ আছেন ২৮ জন, তাদের মধ্যে ১৫ জনই নরসিংদীর।

সলিল সমাধির হাত থেকে বেঁচে ফেরা ৬জনের মধ্যে দুজন গত বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেন। তাদের একজন নরসিংদীর রায়পুরার  খোরশেদ মৃধার ছেলে ইউসুফ মৃধা(২৯) ও অন্যজন ফরিদপুরের নগরকান্দার ইউনুস শেখের ছেলে শেখ সামিউল(১৮)। বর্তমানে এ দুজন রাজধানীর হাজীক্যাম্পে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। তাদের মাধ্যমেই এতদিন পর ‘ওই দিন ঠিক কি ঘটেছিল’ তার বিস্তারিত জানতে পারেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা।

গত শুক্রবার বিকেলে এ বিষয়ে ইউসুফ মৃধা ও শেখ সামিউলের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তারা জানান, গত ২৭ জানুয়ারি লিবিয়ার স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে দুই মিশরীয় চালক আমাদের ৩৫জনকে নিয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হন। ভূমধ্যসাগরে পাড়ি দেওয়ার সময় পড়ে যাওয়া একজনকে তুলতে গিয়ে স্পিডবোটটি উল্টে যায়। এরপর ওই প্রচন্ড ঠান্ডা পানিতে প্রায় ১১ ঘণ্টা ভেসে ছিলেন তারা। চোখের সামনে ১০ থেকে ১২ জনকে মারা যেতে দেখেছেন। কূল-কিনারাহীন সাগরে  ঢেউয়ের ধাক্কায় এক এক করে ভেসে গেছেন তারা। তবে তারা মোট ৬ জন উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করায় বেঁচে গেছেন। এতদিনেও নিখোঁজ ২৮ বাংলাদেশদের কোনো সন্ধান না পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, তাদের সবারই সলিল সমাধি হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  উন্নয়ন দেখাতে চট্টগ্রামে কূটনীতিকদের নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

নিখোঁজদের মধ্যে নরসিংদীর ১৫ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন, রায়পুরার ডৌকারচরের নাদিম সরকার (২২), আলমগীর সরকার (৩৫), আল-আমিন ফরাজী (৩৩), দক্ষিণ মির্জানগরের এস এম নাহিদ (২৫), আমিরগঞ্জের ইমরান মিয়া (২১), আশিস সূত্রধর (২১), সবুজ মিয়া (২৫), হাইরমারার শাওন মিয়া (২২), সেলিম মিয়া (২৪) ও বেলাব উপজেলার বেলাবর আল আমিন (২৮), নারায়ণপুরের মতিউর রহমান (৩৭), সল্লাবাদের শরীফুল ইসলাম (২৪), সালাউদ্দিন (৩২), মো. হালিম (২৬),  বিপ্লব মিয়া (২৪)। এছাড়া বাকী ১৩ জন ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও সিলেট জেলার বাসিন্দা।

রায়পুরার ডৌকারচরের নিখোঁজ তিন যুবকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদের তারেক মোল্লা নামের এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নাদিম, আল আমিন ও আলমগীরের। তিনমাস আগে ইতালি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য সাড়ে ৮ লাখ টাকায় ওই দালালের সঙ্গে চুক্তি করেন তারা। সাড়ে ৬ লাখ টাকা করে তাঁর হাতে  দেওয়ার পর গত ২৭ ডিসেম্বর তারা ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হন। প্রথমে তাদের দুবাই নিয়ে এক সপ্তাহ রাখা হয়। পরে মিশর হয়ে তাদের পাঠানো হয় লিবিয়ার বেনগাজী শহরে। সেখানে খাদ্যসংকটে আরও প্রায় ১০ দিন থাকার পর ব্যক্তিগত গাড়ির ডেকের ভেতরে ভরে দুই দিনের ভ্রমণ শেষে তাদের নেওয়া হয় ত্রিপোলি শহরে। সেখানে তারা দেখা পান এ চক্রের মূল দালাল মনির চন্দ্র শীল নামের এক ব্যক্তির, যার বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদে। 

তারা আরও জানান, এ তিনজনসহ আরও অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন দালাল মনির চন্দ্র শীলের বাড়িতে থাকেন আরও সাতদিন। সেখানে অবস্থানের সময়ই তারা জানতে পারেন, বৈধভাবে ইতালি নেওয়ার কথা বলে দেশ থেকে তাদের নেওয়া হলেও এখন তাদের সেখানে পাঠানো হবে অবৈধভাবে। পরে তাদের কাছে গেমিংয়ের (লিবিয়া থেকে বোটে করে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার নাম গেমিং) পরিকল্পনা জানানো হয়। তাদের জানানো হয়, ৩০০ সিসির দুইটি ইঞ্জিনের একটি স্পিডবোটে করে তাদের নেওয়া হবে, যার ধারণক্ষমতা অন্তত ৫০ জন। মোট ৪২ জনকে নিয়ে জোয়ারা ঘাটে গেলে দেখা যায়, ওই স্পিডবোটটিতে ১৬০ সিসির একটি ইঞ্জিন রয়েছে যার ধারণক্ষতা সর্বোচ্চ ২৫ জন। ২৫ জনের জায়গায় ৪২ জনকে উঠানো হলে চালক পাঁচজনকে নামিয়ে দেন। গত ২৭ জানুয়ারি স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে মিশরীয় দুই চালক স্পিডবোটটিতে ৩৫জন বাংলাদেশীকে নিয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হন।

আরও পড়ুনঃ  রায়গঞ্জে চাষীদের কৃষি প্রণোদনা বিতরণ

বেঁচে ফের শেখ সামিউল জানান, ২৫ জনের ধারণক্ষমতার স্পিডবোটে আমরা ছিলাম ৩৫জন। লাইফ জ্যাকেট বা কোনো ধরণের সেফটি ইকুইপমেন্ট আমাদের কাউকে দেওয়া হয়নি। লিবিয়ার থেকে রওনা হয়ে তিউনিশিয়া পার হয়ে মাল্টা জলসীমা অতিক্রম করার সময় আমাদের একজন চলন্ত স্পিডবোট থেকে সাগরে পড়ে যায়। তাকে এমন অবস্থায় রেখে আমরা চলে যাব, এটা আমাদের মনে সায় দেয়নি। পরে স্পিডবোট ঘুরিয়ে তাকে টেনে তোলার সময় এটি একদিকে কাত হয়ে যায়। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা ঢেউয়ের ধাক্কায় স্পিডবোটটি উল্টে গেলে সব যাত্রী সাগরে ডুবে যান। আমাদের মধ্যে ৭ জন কোনরকমে উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে উঠতে পেরেছিলাম। এ সময় স্পিডবোট ধরে ভেসে ছিলেন অন্তত ১৫ জন। ভেসে থাকতে থাকতে বেশ কয়েকজনকে মারা যেতে দেখেছি। আবার অনেকে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছেন অনেক দূরে। ইতালি পৌঁছার আর মাত্র একঘণ্টার মত দূরত্ব বাকী ছিল।

বেঁচে ফেরা ইউসুফ মৃধা জানান, আমি একাই একজনের শার্টের কলার, আরেকজনের মাফলার ও দুই হাতে আরও দুইজনসহ মোট চারজনকে ভাসিয়ে রেখেছিলাম। প্রচন্ড ঠান্ডায় এদের মধ্যে একজনের মুত্যু হলে আমি হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এভাবে এক এক করে সবাই ডুবে যাচ্ছিলেন, কেউ ভেসে যাচ্ছিলেন সাগরের জলে। নিজেরা বাঁচব নাকি অন্যদের বাঁচাব এ ভেবেই সময়গুলো একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল। একটা সময় বহুদূরে কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ ভেসে যেতে দেখি। আমাদের মধ্যে একজনের লাল জামা পরা ছিল, তাঁর জামা খুলে উড়াতে থাকি আমরা। পরে কোস্টগার্ড এসে আমাদের ৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করে নিয়ে যায়। উদ্ধার করে তীরে নেওয়ার পথেই রাশেদুলের মৃত্যু হয়। আমাদের ৬ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর প্রায় একমাস জেলে রাখার পর স্থানীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় আমাদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে আমরা দুজন দেশে ফিরেছি, অন্য চারজনও দ্রুতই দেশে ফিরবেন।

আরও পড়ুনঃ  কক্সবাজারে দুই রোহিঙ্গা নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

নিখোঁজ ব্যক্তিদের কয়েকজন অভিভাবক জানান, ঘটনার পাঁচদিন পর গত ৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় ঠান্ডায় জমে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার মো. রাশেদুল ইসলাম নামের এক যুবকের মৃত্যুর খবর পাই আমরা। এদিকে সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়ায় সন্দেহবোধ থেকে নিহত রাশেদুলের ছবি স্পিডবোট থেকে নেমে যাওয়া ওই পাঁচজনের কাছে পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়, রাশেদুল ও তাদের সন্তানরা একই স্পিডবোটে ছিল কিনা?  একই স্পিডবোটে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করলে আমরা চিন্তায় পড়ে যাই। গত একমাস ধরে আমরা তাদের কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না তবে ৬ জন জীবিত উদ্ধারের পর জেলে থাকার খবর আমরা জানতে পারি। দূতাবাসের মাধ্যমে গত বৃহস্পতিবার সকালে তাদের মধ্যে দুজন দেশে ফিরলে আমরা বিমানবন্দরে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে জানতে পারি স্পিডবোটটির দুই চালকসহ ৩০ জনই সাগরে ভেসে গেছেন।

নিখোঁজ নাদিম সরকারের বাবা সোবহান সরকার জানান, দালাল তারেক মোল্লার মাধ্যমেই রায়পুরার ১২ জনসহ বিভিন্ন জেলার অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন লোক ইতালি রওনা হয়েছিল। তিনি রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদে বসে বৈধভাবে ইতালি  নেওয়ার কথা বলে প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজনকে অবৈধভাবে বিদেশে পাঠান। তাঁর ও মনির চন্দ্র শীলের মত দালালদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়েই আজ এতগুলো পরিবারে কান্নার রোল উঠেছে। তাদের কঠোর শাস্তি হলে, এই ২৮ জনের আত্মা শান্তি পাবে।

জানতে চাইলে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান জানান, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার জন্য যে দেশের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে সে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই শীর্ষে। যে জেলাগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ এ ঝুঁকি নেয় তার মধ্যে নরসিংদী অন্যতম একটি। গত এক দশকে এ পথে কমপক্ষে ৬৫ হাজার বাংলাদেশী শুধু আটকই হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচশতাধিক মানুষ। অথচ যে পরিমান টাকা দিয়ে তারা এমন ঝুঁকি নেন, এ দিয়ে কিন্তু তারা নিজেদের এলাকাতেই কিছু করতে পারেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দালালদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে এ প্রবণতা কমবে না।

নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান জানান, জেলার ১৫ জনসহ  মাট ২৮ জন বাংলাদেশী ভূমধ্যসাগরে ৩৫ দিন ধরে নিখোঁজ থাকার দুঃখজনক বিষয়টি এইমাত্র শুনলাম। এছাড়া নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের কোন সদস্যও আমাদের এ বিষয়ে কিছু জানাননি। এ বিষয়ে কতটুকু কি করা সম্ভব, তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন