শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্ষতির মুখে বনজীবী-পর্যটনখাত

ক্ষতির মুখে বনজীবী-পর্যটনখাত

সুন্দরবনের রাজস্ব বৃদ্ধি

  • দেশি-বিদেশী পর্যটক সংকটের শঙ্কা

গোলপাতার চাহিদা কমে যাওয়ায় এমনিতেই আগ্রহ হারাচ্ছে বাওয়ালীরা। গত বছরের সব গোলপাতা এখনও বিক্রি করতে পারিনি অনেকেই। এ খাতে রাজস্ব প্রায় আড়াইগুন বৃদ্ধিতে গোলপাতা আহরণে পরবর্তী বছর বাওয়ালী পাওয়া নিয়ে চরম শঙ্কা রয়েছে : মীর কামরুজ্জামান বাচ্চু, সভাপতি, খুলনা রেঞ্জের বনজীবী  ফেডারেশন

সুন্দরবন ভ্রমণে পর্যটকদের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। বনজীবীদের রাজস্বও বেড়েছে সমহারে। গোলপাতায়-কাঁকড়ার রাজস্ব বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। ভ্রমণ মৌসুমের শেষ সময়ে এসে বনবিভাগের এ সিদ্ধান্তে চরম ক্ষতির সম্মুখীন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত ঊপকূলীয় বনজীবীরা জীবীকা নিয়ে পড়েছেন চরম শঙ্কায়।

পর্যটন ব্যবসায়ীদের শঙ্কা, সরকার পর্যটনে বিকাশের কথা বললেও হঠাৎ করে এ রাজস্ব বাড়ানোয় নতুন করে ক্ষতির মুখে পড়বে সুন্দরবনের পর্যটন শিল্প। এর ফলে সুন্দরবনের প্যাকেজ ভ্রমণের খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এছাড়া পূর্বের খরচ অনুযায়ী অগ্রিম বুকিং নেওয়া পর্যটন ব্যবসায়ীদের পড়তে হবে চরম বিপাকে ।

পর্যটন মৌসুমের মাঝপথে বন বিভাগ রাজস্ব বাড়িয়ে দেওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন (টোয়াস)। তারা বলছেন, এতে পর্যটন শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত এবং ট্যুর অপারেটররা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এর আগে পুনঃবিবেচনার জন্য সংগঠনটির পক্ষ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি বনবিভাগের কাছে লিখিত আবেদন করা হয়।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসেসিয়েশন অফ সুন্দরবনের (টোয়াস) সাধারণ সম্পাদক ও রূপান্তর ইকোট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল আজম ডেভিড জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে ট্যুর অপারেটররা গত দুই বছরে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বছর পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় তারা ফের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এখন আবার বন বিভাগ রাজস্ব বৃদ্ধি করায় চরম বিপাকে পড়েছেন তারা।

আরও পড়ুনঃ  বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথে শপথ

নাজমুল আজম ডেভিড ক্ষোভের সাঙ্গে বলেন, পর্যটনকে নিয়ে সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কাজ করলেও এ বিষয় যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা না করায় ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত হয় নি। আমরা ক্ষতির মুখে পড়েছি।

তিনি আরও বলেন, তাদের অবগত না করে হঠাৎ মৌসুমের মাঝখানে রাজস্ব বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সামনের দিনগুলোর বেশিরভাগ ট্যুরই ইতোমধ্যে বুক হয়ে গেছে। ট্যুর অপারেটররা সাধারণত মৌসুম শুরু হওয়ার আগে রাজস্বসহ সবকিছুর সঙ্গে সংগতি রেখে ট্যুর প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেন। এতে চরম খেসারত দিতে হবে তাদের।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসেসিয়েশন অফ সুন্দরবনের (টোয়াস) সভাপতি ও এভাগ্রীণ  ইকোট্যুরিজমের পরিচালক মঈনুল ইসলাম জনান, আকস্মিক দ্বিগুণ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের তুলনায় পর্যটকরা সুন্দরবনের প্রতি আগ্রহ হারাবে। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকের আগমন অনেকাংশে কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

একই সঙ্গে সুন্দরবনে পর্যটনের পাশাপাশি দুবলার চরে রাস মেলায় পুণ্যার্থী ও সুন্দরবনে সব ধরনের বনজীবীদের জন্যও নতুন রাজস্ব হার নির্ধারণ করে দিয়েছে বন বিভাগ।

গোলপাতা প্রতি কুইন্টাল ২৫ টাকা থেকে ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সুন্দরবনের ভেটকি মাছের রাজস্ব প্রতি কুইন্টালে ১২০০ টাকা থেকে ২৪০০ টাকা ও কাঁকড়া কুইন্টাল প্রতি ২৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা করা হয়েছে।

খুলনা রেঞ্জের বনজীবী ফেডারেশনের সভাপতি মীর কামরুজ্জামান বাচ্চু বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আম্পান-ইয়াসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। করোনায় কাঁকড়াসহ মাছের দাম পড়ে যায়। অনেকাংশে কমে যায় চাহিদা। অপরদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ব্যাপক বেড়েছে। সব মিলিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে আমাদের। এরইমধ্যে বনবিভাগ দ্বিগুণের বেশি রাজস্ব বৃদ্ধি করে তাদের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  আগামী সপ্তাহে বাড়তে পারে শীতের তীব্রতা

তিনি আরও বলেন, গোলপাতার চাহিদা কমে যাওয়ায় এমনিতেই আগ্রহ হারাচ্ছে বাওয়ালীরা। গত বছরের সব গোলপাতা এখনও বিক্রি করতে পারিনি অনেকেই। এ খাতে রাজস্ব প্রায় আড়াইগুন বৃদ্ধিতে গোলপাতা আহরণে পরবর্তী বছর বাওয়ালী পাওয়া নিয়ে চরম শঙ্কা রয়েছে।

পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা কুপ কর্মকর্তা নির্মল কুমার মন্ডল বলেন, সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জের একটি গোলপাতা কুপে প্রথম দফায় গোলপাতা সংগ্রহে ১১৮ টি বিএলসির অনুকূলে বাওয়ালীরা ৫৮ হাজার ৬শ’ ৬০ মণ গোলপাতা সংগ্রহ করার অনুমতি (পারমিট) নিয়েছেন। গেল বছর ১৪৫ টি বিএলসির অনুকূলে গোলপাতা সংগ্রহ করেন ১ লাখ ৫০ মন। চাহিদা কমে যাওয়ায় বাওয়ালী কমে যাচ্ছে।

তবে রাজস্ব বাড়ানোকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা ড. আবু নাসের মো. মহসিন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পরে সবার ক্ষেত্রেই রাজস্ব বৃদ্ধি করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনটি জারি করেছে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এরআগে ২০১১ সালে রাজস্ব বৃদ্ধি করা হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, এতে পর্যটন আগমণে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। কারণ পর্যটকরা রাজস্ব দেখেন না, প্যাকেজ হিসেবে ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তি করেন। তবে অগ্রিম বুকিং নেয়া ট্যুর অপারেটরদের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে বলে স্বীকার করেন তিনি।

সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা  বেলায়েত হোসেন বলেন, সব ক্ষেত্রেই রাজস্ব বেড়েছে। আমাদেরতো দীর্ঘদিন পরে বাড়লো। এতে বনজীবী কিংবা পর্যটক কারো উপর তেমন চাপ পড়বে না।

আরও পড়ুনঃ  হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্য মাটির বাড়ি

নতুন প্রজ্ঞাপনে ধার্য করা রাজস্বের তালিকা থেকে জানা যায়, সুন্দরবনের সাধারণ জায়গাগুলোতে মাথাপিছু দেশি পর্যটকের ভ্রমণ ফি ছিল প্রতিদিনের জন্য ৭০ টাকা, সেটা বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা। বিদেশি পর্যটকের আগে খরচ হত প্রতিদিন ১০০০ টাকা, এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০০০ টাকা । সুন্দরবনের ভেতরে কটকা, কচিখালী, নীলকমল, হিরণ পয়েন্ট, নোটাবেকী, পুষ্পকাঠী, মান্দারবাড়িয়া, হলদেবুনিয়ার মত সরকার ঘোষিত অভয়ারণ্যগুলোতে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের প্রতিদিন ভ্রমণ ফি দিতে হত যথাক্রমে ১৫০ ও ১৫০০ টাকা। এখন তা দ্বিগুণ বেড়ে যথাক্রমে ৩০০ ও ৩০০০ টাকা হয়েছে। অবস্থান ফি ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা, এক দিনের পাসে কলাগাছিয়া ট্যুরিস্ট কেন্দ্রে গেলে ২০ টাকার ফি ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গাইড ফি ৫০০ টাকা থাকলেও এখন গুনতে হবে ৭৫০ টাকা। নিরাপত্তা গার্ড ফি ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে  ১৫ শতাংশ ভ্যাট।

সংবাদটি শেয়ার করুন