ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আধুনিকায়নে শুঁটকিখাত

আধুনিকায়নে শুঁটকিখাত

মুক্ত জলাশয়ে মাছ শিকারে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। উৎপাদিত মাছের ৭০ ভাগ তাজা, ২৫ ভাগ শুঁটকি, মাত্র ৫ ভাগ প্রক্রিয়াজাত হিসেবে বিপণন হয়। উপকূলে ৮-১০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ শুঁটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত হয়। আমদানি করা শুঁটকির এসব উন্নতমানের। যা রপ্তানি হচ্ছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইয়ে।

মৎস্য প্রক্রিয়াকরণে মৎসীজীবীদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে: শ ম রেজাউল করিম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী

বহু যুগ আগে থেকেই তাজা মাছের পাশাপাশি খাদ্যতালিকায় স্থান করে নিয়েছে শুঁটকি। উপমহাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বহু দেশে প্রোটিনের উৎস হিসেবে শুঁটকি এখন ব্যাপক জনপ্রিয়। কাঁচা মাছের বিকল্প হিসেবে বিশ্বজুড়ে শুঁটকির চাহিদা যেমন বাড়ছে তেমনি বাজারও বড় হচ্ছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ শুঁটকির সম্প্রসারিত বাজারের বড় ধরনের অংশীদার হয়ে উঠতে পারে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, মুক্ত জলাশয়ে মাছ শিকারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। দেশে উৎপাদিত মাছের ৭০ ভাগ তাজা মাছ হিসাবে পাওয়া যায়। বাকি ২৫ ভাগ আমরা পাই শুঁটকি হিসেবে। মাত্র ৫ ভাগ মাছ প্রক্রিয়াজাত হিসেবে বিপণন হয়। দেশীয় উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ৮ থেকে ১০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বাণিজ্যিকভাবে শুঁটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। দেশে উৎপাদিত শুঁটকি এখন ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইয়ে রপ্তানি হচ্ছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই হাজার ২২৯ টন শুঁটকি রপ্তানি করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেই রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৮১ টনে, যার বাজার মূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। সমন্বিত পরিকল্পনা থাকলে রপ্তানির হার বহুগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

শুঁটকির আধুনিকায়ন

দেশের মৎস্যসম্পদের উন্নয়নে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিকমানের শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন করা হচ্ছে। ১৯৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন। দেশে মাছ আহরণ করার পর অপচয় হ্রাস, আধুনিক পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন শুঁটকি মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। কক্সবাজারের খুরুশকুল এলাকায় সাড়ে চার হাজার জেলে পরিবারের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে প্রকল্পটির মাধ্যমে।

সম্প্রতি কক্সবাজারে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন প্রকল্পের অফিস ভবন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। প্রকল্পটির মাধ্যমে খুরুশকুলে দুই হাজার ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের অবতরণ শেড নির্মাণ করা হবে। এক হাজার ৮৬০ বর্গমিটার আয়তনের ৪ তলা বিশিষ্ট ল্যাব, অফিস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কাম ডরমেটরি নির্মাণ করা হবে। দুটি ওয়ে ব্রিজ এবং তিনটি পন্টুন গ্যাংওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়াও ৩৫০টি গ্রিন হাউজ মেকানিক্যাল ড্রায়ার এবং ৩০টি মেকানিক্যাল ড্রায়ারের পাশাপাশি প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি ও ৩৬টি শুঁটকি বিক্রয় কেন্দ্রও স্থাপন করা হবে।

শুটকির বাজার

দেশের মানুষের বার্ষিক জনপ্রতি মাছের চাহিদা ২০ দশমিক ৪৪ কেজি। চাহিদার বিপরীতে বার্ষিক জনপ্রতি খাদ্য হিসাবে মাছ গ্রহণ ১৮ দশমিক ৯৪ কেজি অর্থাৎ ১ দশমিক ৫০ কেজি ঘাটতি থাকে। এই মাছের প্রায় ৫ ভাগ আসে শুঁটকি থেকে। বছরে প্রায় ৫ দশমিক ৪৬ লাখ টন মৎস্য আহরিত হয় সমুদ্র থেকে। যার ২০ শতাংশ শুঁটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।

দেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে শুঁটকি মাছ উৎপাদন করা হয়। সবচেয়ে বেশি শুঁটকি উৎপাদিত হয় সুন্দরবনের দুবলার চড়, সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ড, সোনাদিয়ার চড়, মহেশখালী, কক্সবাজারের নাজিরাটেক, সুনামগঞ্জের ইব্রাহীমপুর, জামালগঞ্জের জশমন্তপুরসহ অন্যান্য জায়গায়। এছাড়াও উত্তরাঞ্চলে শুঁটকি মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে নাটোরের সিংড়া (বিশেষ করে চলনবিল এলাকার আশেপাশে), সিরাজগঞ্জ, নীলফামারীর সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর অন্যতম।

শুঁটকির মধ্যে সবচাইতে দামি হচ্ছে লাক্ষা ও রূপচাঁদা শুঁটকি। বর্তমানে এক কেজি রূপচাঁদা শুঁটকি তিন থেকে চার হাজার টাকা,  লাক্ষা চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ছুরি শুঁটকি ৫০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে বিক্রি হয় চট্টগ্রাম বাজারে। শুঁটকির মধ্যে কম দামের মিশালী শুঁটকি। তবে লইট্ট্যার চাহিদা বেশি। বর্তমানে প্রতি কেজি লইট্ট্যা শুঁটকি বিক্রি হয় সাড়ে তিনশ’ থেকে ছয়শ’ টাকার মধ্যে।

বাংলাদেশের উৎপাদিত সামুদ্রিক শুঁটকির সবচেয়ে বড় অংশ তৈরি হয় কক্সবাজারে।  নাজিরাটেক এলাকাকে দেশের শুঁটকি উৎপাদনের বৃহত্তম কেন্দ্রস্থল তথা শুঁটকির গ্রাম বলে বিবেচনা করা হয়। কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের পাশ ঘেঁষে প্রায় একশ একর বালুচর জুড়ে গড়ে উঠেছে নাজিরাটেকের শুঁটকি মহাল। দেশে উৎপাদিত শুঁটকির প্রায় আশি শতাংশ এই নাজিরাটেকেই পাওয়া যায়।

এখানকার শুঁটকি ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, প্রতি মৌসুমে বিশেষ করে শীতের শুরুতে শুধুমাত্র নাজিরাটেক শুঁটকি মহলে মাছের গুড়াসহ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় দুশ কোটি টাকা।

প্রস্তুতি ও সংরক্ষণ

খাদ্য সংরক্ষণের প্রাচীন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল খাদ্যকে প্রখর সূর্যতাপে বা বাতাসে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা। কোনো মাছকে যখন সূর্যের তাপে বা শুষ্ক পরিবেশে বাতাসে শুকিয়ে এর ভেতরের জলীয় অংশ অপসারণ করে পরবর্তিতে খাবার উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করাকে মাছের শুঁটকিকরণ বলা হয়। মাছটি শুঁটকি মাছ নামে পরিচিতি পায়।

শুটকির গুণ

প্রতি ১০০ গ্রাম শুঁটকি থেকে প্রায় ৩৭১ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়। যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। শুঁটকি থেকে প্রাপ্ত খাদ্যপুষ্টির আশি শতাংশই প্রোটিন। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মাছ শুকানোর সময় প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেন। অতিরিক্ত রাসায়নিক দ্রব্য সেবন সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

সরবরাহ সংকট

দেশ থেকে এক সময় শুঁটকির স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা হলেও এখন দেশের চাহিদাই মেটাতে হচ্ছে আমদানি করে। প্রতিবছর দেশে শুঁটকির চাহিদা ও দাম বাড়তে থাকলেও উৎপাদন কমতে থাকায় এখন চাহিদার ৭০ ভাগ মেটাতে হচ্ছে আমদানি করে। শুঁটকি উৎপাদনের বড় উৎস সাগরের মাছ হলেও প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উৎপাদন কমছে। তাছাড়া শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ ব্যয় বৃদ্ধি ও জলসদ্যুদের উৎপাতে অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করছে। ফলে উৎপাদন কমে বছর বছর শুঁটকির দাম বাড়ছে।

শুঁটকি ব্যবসায়ী আসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রতিবছর শুঁটকির চাহিদা রয়েছে ৫৫ হাজার ৫০০ টন। যেখানে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে ২০ হাজার টনের মতো। আর বাকি ৩৫ হাজার ৫০০ টন আমদানি করতে হচ্ছে। আর চাহিদার এই ৭০ ভাগ আমদানি হচ্ছে মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান থেকে। আমদানি করা শুঁটকির চেয়ে দেশে উৎপাদিন শুটকির মান উন্নত। তাই দেশে উৎপাদিত শুঁটকির ২০ ভাগ রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাজ্যসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। আর সরবরাহ স্বল্পতায় প্রতি বছর ২০ ভাগ হারে শুঁটকির দাম বাড়ছে।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ও রপ্তানি আয় বাড়াতে সরকার শুঁটকি উৎপাদন বাড়াতে যেমন আন্তর্জাতিকমানের শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন করছে তেমনি জেলে ও উৎপাদনে জড়িতদের সহায়তা দেয়ারও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি কক্সবাজারে গিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছেন, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণে মৎসীজীবীদের রাষ্ট্র সব ধরনের সহায়তা করা হবে। বিদেশ থেকে মেশিনারি আমদানি করে বা স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কেউ স্থাপনে করতে চাইলে কর অব্যাহতিসহ অন্যান্য সুবিধাদি দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। ফলে উৎপাদন বাড়ার মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়বে। তাতে এ খাতে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন