রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অবৈধ করাতকলে উজাড় হচ্ছে বন, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব

অবৈধ করাতকলে উজাড় হচ্ছে বন, হারাচ্ছে সরকার রাজস্ব

নরসিংদীতে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই শতাধিক অবৈধ করাতকল চলছে। এতে সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব। এমনচিত্র নরসিংদী রায়পুরা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে। সরকারি নিয়ম ও নির্দেশনা তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে গড়ে ওঠেছে নামে বেনামে শতাধিক অবৈধ করাতকল। পরিবেশ ও বন বিভাগের ছাড়পত্র ও লাইনেন্স ছাড়াই যত্রতত্র গড়ে উঠেছে এ করাতকল গুলো।

স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাব ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় নজরধারী না থাকায় এ উপজেলায় যত্রতত্র গড়ে উঠেছে এ সব স’মিল বা করাত কল। এসব মিলে কারণে উজাড় হচ্ছে বনজ, ফলজসহ নানান প্রজাতির গাছ। এতে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ।

তবে স’মিল মালিকরা বলছেন, উপজেলা বন বিভাগের কর্মকর্তার অফিসে গিয়ে প্রায়ই বন্ধ পাওয়া যায়। এদিকে বন বিভাগের কর্মকর্তা বলছেন, উপজেলায় কেউ দায়িত্ব না থাকায় অতিরিক্ত দায়িত্বের কারণে মাঝে মধ্যে অফিস করতে হয় তাকে। অন্যদিকে, স্থানীয় সচেতন মহল দ্রুত এ সকল অবৈধ করাতকল বন্ধের দাবি জানিয়েছেন ।

উপজেলা বন বিভাগের তথ্যমতে, রায়পুরা উপজেলায় ৬৩টি করাতকল রয়েছে। ১০টি লাইসেন্স থাকলেও নবায়ন হয় না দীর্ঘদিন যাবত। লাইসেন্সর আবেদন পড়েছে ১৩টি। গত এক বছরের অধিক সময় ধরে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বর্তমানে উপজেলার কয়েকটি স’মিল রয়েছে তা সঠিক তথ্য জানেন না বন বিভাগ।

উপজেলা বনবিভাগ আরও বলছে, অনুমোদনহীন এসব মিলে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়মিত তদারকি না করায় সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। করাতকলের মালিক ও অসাধু কাঠ ব্যবসায়ীরা নিরবেই এসব কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে-সেখানে স’মিল স্থাপনের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। এতে হুমকির মুখে পরছে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র। কমছে অক্সিজেনের ভারসাম্য।

আরও পড়ুনঃ  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বন আইন ১৯২৭ ও তৎপ্রণীত স’মিল (লাইসেন্স) বিধিমালা ২০১২ অনুযায়ী কোনো স’মিল মালিক লাইসেন্স না নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না। লাইসেন্স নেয়ার পর থেকে প্রতিবছর তা নবায়ন করতে হবে। স’মিল স্থাপনের জন্য বন বিভাগের লাইসেন্স পাওয়ার পর নিতে হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, এ ছাড়া যেখানে-সেখানে স’মিল স্থাপন করা যাবে না।

উপজেলার বিভিন্ন স’মিল (করাত কল) ঘুরে দেখা যায়, মিল চালানোর ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট বিধান থাকলেও উপজেলায় এ চিত্র একেবারেই বিপরীত। এসব মিল মালিকরা দীর্ঘদিন যাবত অনুমোদন ছাড়াই চালাচ্ছে স’মিল। লাইসেন্সবিহীন স’মিলগুলো বন্ধ করার কোনও উদ্যোগও দীর্ঘদিন যাবত চোখে পড়েনি বলে জানান স্থানীয়রা। এসব মিল চত্বরে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মজুত করে রাখা হয়েছে। কাক ডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এসব মিলে বিরামহীন চলছে কাঠ কাটার কাজ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক করাতকল মালিক বলেন, দীর্ঘদিন আমাদের স’মিল চলছে। অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছি এখনও অনুমোদন পাইনি। মিল যখন চালু করেছি তাই বন্ধ রাখতে পারি না এ ভাবেই চালাচ্ছি।
কয়েকজন করাতকল মালিকের কাছে অনুমোদন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি আবেদন করেছি। তবে অনুমোদন পেয়েছেন কিনা তা জানতে চাইলে কথা না বলে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।

উপজেলার কয়েকজন কাঠ ব্যবসায়ী জানান, ‘আমরা কাঠের ব্যবসা করি। বিভিন্ন এলাকায় গাছ মালিকদের থেকে কিনে মিলে এনে বিক্রি করি। এ ব্যবসা করে আমাদের সংসার চলে। মিলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এমনিতেই।
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন, উপজেলায় অন্তত শতাধিক অবৈধ করাতকল রাতারাতি যত্রতত্র গজিয়ে উঠছে। এভাবে সরকারের অনুমোদনবিহীন করাত কল (স’মিল) চলায়। একদিকে পরিবেশ হচ্ছে নষ্ট হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে, অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

আরও পড়ুনঃ  ৯৩% মেধার ভিত্তিতে চাকরির প্রজ্ঞাপন

নরসিংদী পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি মইরুল ইসলাম নীরু বলেন, যারা অবৈধভাবে এ স’মিল চালাচ্ছেন, তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লোকজনের সাথে যোগসাজসে এ কর্মকান্ড করে থাকেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রায়ই বলে থাকেন তাদের লোকবল কম থাকায় সব সময় নজরদারী করতে পারেন না। তারা সবই জানেন অবৈধ স’মিল কয়টা আছে আর বৈধ স’মিল কয়টা। আমি মনে করি অচিরেই এই অবৈধ স’মিল গুলোকে আইনের আওতায় আনা হোক।

পপুলার টিম্বার ট্রেডিং এন্ড স’মিল এর স্বত্বাধিকারী পরেশ সূত্রধর বলেন, একটি স’মিল মালিক লাইসেন্স বাবদ বছরের সরকারকে নূন্যতম ৩ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এর পরেই সরকারি ট্যাক্স ও ভ্যাট। এসব কারণে সরকার প্রতিবছর প্রায় কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছেন। যারা অবৈধ ভাবে স’মিল চালাচ্ছেন তাদেরকে দ্রুত লাইসেন্স নবায়ন ও ট্যাক্স ও ভ্যাটের আওতায় নিয়ে আসা হোক। আমরা যারা বড় বড় স’মিল মালিকরা আছি তারা শুধু সরকারকে ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রদান করে থাকি। এজন্য প্রতি বছরই আমি সেরাকরদার হিসেবে সরকারি তালিকায় নাম থাকে। তাই আমি মনে করি যারা স’মিলের ব্যবসা করছেন তার সবাই বৈধভাবে ব্যবসা করেন।

উপজেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বলেন, বর্তমানে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নাই। আপনি যা জানেন তাই সঠিক। অবৈধ স’মিলগুলোর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া অবৈধভাবে স’মিল স্থাপন বা চালানোর কোনো সুযোগ নেই। অবৈধ করাতকলের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ভ্র্যাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আরও পড়ুনঃ  করোনাভাইরাস : দ্রুত বিস্তারের সম্ভাবনা ঝুঁকিতে দক্ষিণ এশিয়া

নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, যখন কোনো করাতকলের জন্য ছাড়পত্র নিতে আসে তখন প্রথমে আমরা দেখি বন বিভাগের লাইসেন্স আছে কিনা। যদি থাকে তখন বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর মিলে তাদেরকে আমরা ছাড়পত্র দিয়ে থাকি। স’মিলের সব কিছুই দেখেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও আজগর হোসেন বলেন, এটা সম্পূন্ন বন বিভাগের কার্যক্রম। লিখিত অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারি। বনবিভাগ উপজেলা প্রশাসনের যে কোনো সহযোগিতা চাইলে সব সময় দিতে প্রস্তুত।

সংবাদটি শেয়ার করুন