রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জলবায়ুর থাবায় বসন্ত

জলবায়ুর থাবায় বসন্ত

মলিন-ধূসর ফাগুন আর মন রাঙায় না

হিমালয়ের পদতলে পাহাড়ের কুইনখ্যাত দার্জিলিংয়ে বসে আজ থেকে প্রায় দেড়শ’ বছর আগে বিশ্বকবি রবীঠাকুর লিখেছিলেন- ‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,/ এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,/ সখীর হৃদয় কুসুম-কোমল-/ কার অনাদরে আজি ঝরে যায়’…। ঋতুরাজ বসন্ত নিয়ে বিখ্যাত এ কবিতা (গীতিকবিতা) কিন্তু কবি অগ্রহায়ণ মাসে লিখেছিলেন। মানে হেমন্তের শেষ দিকে। তথ্য সত্য হলে বলতে হবে, পাহাড়ের রানীর ছোঁয়ায় কবির ভেতর তখন বসন্ত জাগ্রত হয়েছিল।

তবে সেই ঘটনার দুই দশক পর কবি বোলপুরে বসে চৈত্রের শেষে বসন্তের বিদায় বেলায় লিখেছিলেন- ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/ কোরো না বিড়ম্বিত তারে।/ আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,/ আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,/ এই সংগীত-মুখরিত গগনে’…।

এখানে আর কল্পচিত্র নেই। সরাসরি বসন্ত সমীরণে গা এলিয়েই কবি এমন শব্দ চয়ন করেছিলেন। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, আজি হতে শত বছর আগে কেমন ছিল ঋতুরাজ বসন্তের রূপ। তাহলে রবীঠাকুরের কবিতা থেকে একটা চিত্রকল্প আঁকতে পারি আমরা। যেখানে তৎকালীন বসন্ত ধরা দিতে পারে।

যেমন, চারদিকে প্রকৃতির অপরূপ সাজ। শীতের পাতাঝরা বৃন্তে নতুন পত্রপল্লব। নাম না জানা শত বনফুলের মৌ-মৌ। শত রঙের প্রজাপতি আর ভ্রমরের গুঞ্জনে মুখরিত চারপাশ। মন উদাস করা স্বচ্ছ নীল আকাশ। বুকের ভেতরে রাগ-অনুরাগের হাহাকার। তবে চিরচেনা বসন্তের এই রূপের দেখা আর মিলছে না। শত বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে প্রকৃতি। বদলে গেছে ‍ঋতুভিত্তিক কবির অনুরাগ-বিরাগ, আকুতিও।

আরও পড়ুনঃ  করোনায় বিশ্বে আক্রান্ত ছাড়াল ১০ কোটি ৩১ লাখ

২০১৪ সালে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের অন্যধারার ‘চতুষ্কোণ’ চলচ্চিত্রে অনুপম রায়ের লেখা গানে লগ্নজিতার কণ্ঠে বসন্তের অন্যরকম বার্তা পাওয়া যায়- বাতাসে বহিছে প্রেম,/ নয়নে লাগিলো নেশা/ কারা যে ডাকিলো পিছে,/ বসন্ত এসে গেছে…।

এখানে বসন্ত কবির চোখে বদল ঘটিয়ে দিয়েছে। ঋতুর বদল ঘটলে বদলে যায় কবিতা কিংবা গীতিকবিতার ধরনও। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনে বদলে যাচ্ছে আমাদের চিরচেনা ঋতুর বৈচিত্র। বদলে যাচ্ছে প্রকৃতির আচরণও। শতবর্ষ আগের বসন্তের রূপ বৈচিত্রের সঙ্গে আজকের বসন্তের ধূসর রূপ-রস বড় অচেনা-অনিবার্য।

তাই নতুন কোনো কবি যদি লেখেন, ‘আমার চোখে বসন্ত দারুণ চৈত্রমাস/ চতুর্দিকে শিমূল-পলাশ কৃষ্ণচূড়ার ত্রাস’.. তাহলে দোষ দেয়া যায় না। কারণ সবকিছুর মধ্যেই এখন ত্রাস ভর করেছে। আবার কেউ যখন লেখেন, ‘যদি বসন্ত পলাশ খোঁজে, খুঁজুক তুমি খুঁজো না/ রাঙামাটির পথে হাঁটতে ইচ্ছে করলে, হেঁটো না/ শুধু আমাকে খুঁজো’… তখন যেন মনে হয়, বসন্ত মূখ্য নয়, ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়াই আসল কথা।

কবিকে কখনও দোষ দেয়া যায় না। কারণ কবি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন না। বরং প্রকৃতিই কবিকে, কবিমানসকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বদলে যাওয়া আজকের ধূসর বসন্তে কবিগুরুর মধুর কবিতাও হারিয়ে ফেলে সময়ের দাবি। কোনো নতুন কবি যখন লেখেন, ‘বসন্ত তবে এসেই গেল, বুঝলে ভায়া!/ একটা কুকুর শুকছে আমার পায়ের ধুলো/ চমকে উঠে পেছনে দেখি, কি বেহায়া! তাহলে কার কী করার আছে?

সারাবিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের বড় প্রভাব পড়েছে ষড়ঋতুর বাংলাদেশেও। গেল কয়েক দশকে প্রকৃতির আগ্রাসী আচরণে ওলট-পালট হয়ে গেছে চিরচেনা আমাদের প্রিয়তম ঋতুচক্র। অসময়বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অতিখরা, লাগামছাড়া শৈত্যপ্রবাহ কিংবা তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামায় হারিয়ে গেছে শরৎ, হেমন্ত আর বসন্তের মনভোলানো রূপ। প্রকৃতিতে এখন শুধুই গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীতের দাপট। কখনও কখনও আবার এসব ঋতু ঘিরেও প্রকৃতির অজানা-অচেনা উৎকট আচরণ।

আরও পড়ুনঃ  ফাইলবন্দি বাণিজ্যের স্বপ্ন

বৈরী এই প্রকৃতিই কেড়ে নিয়েছে জীব আর প্রাণীরাজ্যের শত শত প্রজাতি। হারিয়ে গেছে বনফুলের অপার সৌন্দর্য। উধাও হয়ে গেছে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ানো নানা রঙের প্রজাপতি কিংবা ভ্রমরের গুঞ্জন। হারিয়ে গেছে জোনাকজ্বলা স্বর্গীয় সন্ধ্যাগুলো। আধুনিক সভ্যতায় উন্নয়ন আগ্রাসন, দূষণের মহামারি আর যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কদের জন্য পরিবেশ-প্রতিবেশ আজ সবচেয়ে বড় হুমকিতে। বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে মানবসভ্যতা। আলোক দূষণে হারিয়ে গেছে রাতের আকাশের অপার সৌন্দর্য। আধুনিক মানুষ আর খইফোটা তারকার খোঁজ করে না, চাঁদ মামাকে ডাকে না।

কৃত্রিম আলোয় ঝলসানো দামি হোটেল, মোটেল রিসোর্টি ভোগের পেয়ালায় ডুবে থাকা এক সভ্যতার দ্রুত বিস্তার ঘটছে। যেখানে বসন্তের সৌন্দর্য শুধুই বইয়ের পাতায় লেখা ইতিহাস। নগরের মিলনায়তনগুলোতে কৃত্রিম আলোয় রাতভর চলে বসন্ত বিলাসের বিকৃত রিহার্সেল। ঋতুর বৈচিত্র তাই নগরের কৃত্রিম আলোয় মঞ্চে ফুটিয়ে তোলা নস্টালজিক চিত্রকল্প ছাড়া কিছুই নয়। বসন্তের রূপ-রস-গন্ধহীন প্রজন্ম আর লিখতে পারে না বন উদাসী বাতাসের গল্প, কবিতা কিংবা ছন্দ। তাই বসন্ত আজ শুধুই রবীঠাকুরের কবিতায় কিংবা গানে বেঁচে আছে। বসন্তের প্রসঙ্গ এলেই ইউটিউবে জুড়ে দিই মুখস্ত গানগুলো।

অবশ্য, ফাগুন এলেই কারো কারো মনে পড়ে যায় শিমুল, পলাশ কিংবা কৃষ্ণচুড়ার লালে লালে হাওয়া আকাশের কথা। মনে পড়ে ভাষার মাস, ভাষা শহিদদের কথা। ফুলে ফুলে ভরে ওঠা শহিদ মিনারের কথা। তবে আজও সেই চিরচেনা চিত্র রয়ে গেছে। আজও শহিদ মিনার ভরে ওঠে ফুলের স্তূপে স্তূপে। তবে সেই ফুলগুলো নিজের হাতে পরম যত্বে তৈরি করা কোনো বাগান থেকে আর আসে না। আসে বাণিজ্যিক চাষের ফুলবাগান থেকে। যেখানে আগুন ছড়ানো পহেলা ফাগুনের মন রাঙানো অনুভূতি নেই। থাকে না ভালোবাসা দিবসের আবেগ। কেননা, ফুল এখন শুধুই বাণিজ্যিক পণ্য। ফুলেল ভালোবাসা এখন শুধুই করপোরেট বিশ্বের স্বার্থপর কৃত্রিমতা।

আরও পড়ুনঃ  পর্যটনে বৌদ্ধ নিদর্শন সমন্বয়ে কাজ হচ্ছে

তবে কখনও কখনও বদলে যাওয়া চিরচেনা বসন্তের খররোদে নস্টালজিক হয়ে আমরা গেয়ে উঠি, ‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস/ তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ’। সব সর্বনাশের অন্ধকার থেকে শান্তির পথে যাত্রাই হোক আজ আমাদের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি। সেজন্য আজ দাঁড়াতে হবে বিশুদ্ধ প্রকৃতির পাশে। কারণ প্রকৃতি কখনও নিরাশ করে না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘প্রকৃতি তার নিজের ভক্তদের যা দেন, তা অতি অমূল্য দান। অনেক দিন ধরিয়া প্রকৃতির সেবা না করিলে সে দান মেলে না’।

সংবাদটি শেয়ার করুন