শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছর

হুমকিতে সমাজ-পরিবেশ

হুমকিতে সমাজ-পরিবেশ

দ্রুত প্রত্যাবাসন না হলে হারিয়ে যাবে কক্সবাজারের ঐতিহ্য

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আটকে থাকা আর ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে পার হচ্ছে আরেকটি বছর। গতকাল ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে অল্পদিনের মধ্যে বাংলাদেশে এ রোহিঙ্গা ঢল প্রবেশ করে। মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে তাদের বসবাস। এর বাইরে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা। কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা ভাসানচরে পাঠানো হলেও অনেকেই পালিয়ে এসেছে।

তবে রোহিঙ্গা ঢলের এ ৫ বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজন, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ভার এখন বাংলাদেশের ওপর পড়েছে। এদিকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন দাবি নিয়ে গতকাল কক্সবাজারে কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট ও জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত মিস নোয়েলিন হেজার। তাদের কাছে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছে। ক্যাম্প পরিদর্শনে তারা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের জন্য ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কখন, কীভাবে হবে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি কেউ।

এ সময় রোহিঙ্গা যুবক ইউসুফ জানান, প্রতিনিধি দলটি আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। ক্যাম্প কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ অপরাধির তৎপরতা, হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মাদক ব্যবসাসহ সার্বিক পরিস্থিতির কথা প্রতিনিধিদের জানানো হয়। কিছু চিহ্নিত অপরাধি চক্র এমন অপকর্মে জড়িত থাকার বিষয় অবগত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানানো হয়।

কক্সবাজার পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৯৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। খুনাখুনি, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণে ১ হাজার ৯০৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অবশ্যই বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় তথ্যমতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২০টির বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

আরও পড়ুনঃ  মাসিক ও গর্ভাবস্থায় নারীর দাঁতের সমস্যা ও সমাধান

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, প্রত্যাবাসন বিষয়টি দেখছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমরা শুধু রোহিঙ্গাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করাসহ নানা বিষয়ে কাজ করছি। যে কোনো সময় প্রত্যবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করতে আমরা শতভাগ প্রস্তুত রয়েছি। তিনি আরও বলেন, প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও আপাতত ক্যাম্পে চাপ কমানোর জন্য ১ লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩৫ হাজারের অধিক রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রমতে, গেল বছরের শুরুতে চীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরানোর প্রক্রিয়ায় আশার আলো দেখা গেলেও ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে সেটি থমকে যায়। দেশটিতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির টালমাটাল অবস্থার পাশাপাশি কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সেই আলোচনাও আর সামনে আসেনি।

এদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার বারেবারে বলছে, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে নিয়ে যাবে। গেল ৫ বছর ধরে তারা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সক্রিয় ভূমিকা চাইছে। তবে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা ও দেশগুলো তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এর আগে থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাসহ মোট শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখের বেশি। এতে করে উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করে মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে ২ দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়।

আরও পড়ুনঃ  যে পাঁচ খাবারে দ্রুত ওজন বাড়ে

গেল এক বছরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গণমাধ্যমের শিরোনামজুড়ে ছিল কক্সবাজার ও ভাসানচর থেকে এই শরণার্থীদের পালানোর চেষ্টা, কক্সবাজারের ক্যাম্পে আগুন এবং ক্যাম্পকেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড। প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার যে কার্যক্রম সরকার হাতে নিয়েছে, অবশেষে তাতে যুক্ত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘ। সেখান থেকে চলতি মাসে পালানোর চেষ্টাকালে সলিল সমাধি হয়েছে অনেক রোহিঙ্গার। এছাড়া সেখান থেকে গেল ১ বছরে  পালানোর চেষ্টা করে আটক হয়েছে কয়েকশ জন।

একাধিক সূত্র বলছে, রোহিঙ্গা ইস্যু অনেক জটিল। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ঢলের কারণে শুধু এই সংকট তৈরি হয়নি, এই সংকট কয়েক দশকের পুরনো। ওই বছরের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের যে ঢল শুরু হয়, তাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ কক্সবাজারে চলে আসে। যুগ যুগ ধরে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশ আবারও রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়। বিশ্বসম্প্রদায় বাংলাদেশের জোরালো প্রশংসা করলেও এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে প্রত্যাশার চাপে রেখেছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য পশ্চিমা দেশসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলো মানবিক সহায়তা পাঠালেও গেল ৫ বছরে সংকট সমাধান করতে এগিয়ে আসেনি।

পাঁচ বছরের মাথায় সেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। যার কারণে স্থানীয়রা হুমকির মুখে পড়েছে। তারা কথায় কথায় স্থানীয়দের ওপর হামলা করছে। তারা পুরো এলাকাজুড়ে মাদকের ডিপো আর খুন-খারাপি করছে। অপহরণ করে রোহিঙ্গাদের মুক্তিপণ আদায় এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরবাড়িতে চুরি-ডাকাতি করছে। শুধু রোহিঙ্গা প্রবণ সীমান্ত এলাকা উখিয়া-টেকনাফ নয়, কক্সবাজার শহর থেকে শুরু করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কায়দায় এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে জায়গা-জমি জবর দখল করছে।

আরও পড়ুনঃ  নিজের হাতের ভালোবাসার বিশেষ কেক

কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির নেতা অ্যাডভোকেট তাপস রক্ষিত জানান, সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের কারণে এখন রীতিমতো ঝুঁকির মুখে বসবাস করছে। তিনি আরও জানান, শিবিরগুলো এখন স্থানীয় লোকজনের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছে।

এদিকে, চলিত বছরের ১৯ জুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৭ দফা দাবিতে উখিয়া-টেকনাফের ২৯টি ক্যাম্পে একযোগে সমাবেশ করেছিলো রোহিঙ্গারা। যার মধ্যে উখিয়ার ২৭টি ক্যাম্প এবং টেকনাফের ২৬ ও ২৭ নম্বর ক্যাম্পে নানারকম প্ল্যাকার্ড নিয়ে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে মিয়ানমারে দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ ৭ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এসময় তারা বাড়ি ফিরতে ৭টি দাবি উত্থাপন করেন। তারা বলেছিলো, তারা আর এক মুহূর্তও বাংলাদেশে থাকতে চায় না। যেকোনো উপায়ে দ্রুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে হবে। মিয়ানমারে অন্যান্য জাতিগুলোর জন্য যেসব সুযোগ সুবিধা ও নিয়ম-কানুন রয়েছে সেগুলো রোহিঙ্গাদেরও দিতে হবে।

সমাবেশে ৭ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলো মাস্টার নুরুল আমিন। এই দাবীগুলে হলো, দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল করতে হবে, দ্রুত রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ গ্রামে পুনরায় প্রত্যাবাসন করা, অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্দিষ্ট সময়ের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যকর করা, রাখাইন রাজ্যে আইডিপি ক্যাম্প বন্ধ করা এবং তাদেরকে নিজ গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়া, মিয়ানমারে নিরপরাধ মানুষের উপর অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। তবে সংগঠনের নাম না থাকলেও আয়োজক হিসেবে নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো।

ক্যাম্পে কর্মরত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বছরে ৩০ হাজার ৪০০ শিশু জন্মগ্রহণ করছে। সে হিসেবে গেল ৫ বছরে প্রায় ২ লাখ শিশু রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছে। তারা আরও জানিয়েছে, এ নিয়ে মহাবিপদে রয়েছে কক্সবাজারবাসী। যদি রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন করা না গেলে বাংলাদেশ তথা পর্যটন নগরী কক্সবাজার মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। হারিয়ে যাবে ঐতিহ্যর পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন