শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বালির জন্য নদী গ্রাস

আবহমানকাল ধরেই দেশের উত্তর জনপদে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শত শত নদ-নদী। তবে ভারতের নদীশাসন, পদ্মার উজানে ফারাক্কা ও তিস্তার উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ, আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এসব নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এর ওপর নদ-নদী থেকে নির্বিচারে বালি উত্তোলনের উৎসব চলছে উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। বালি উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহসহ প্রাকৃতিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। ঐতিহ্যবাহী বহু নদী ইতোমধ্যে মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গেছে। উত্তর জনপদের নদী গ্রাস করা বালি উত্তোলন নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন-

রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি রেজাউল করিম ও নওগাঁর বদলগাছী প্রতিনিধি।

যেদিকে চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। পায়ে হাঁটা পথে মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে ধান-গম-কাউন-বাদাম-কলাইয়ের ক্ষেত। দু’মাস আগেও যেখানে ১০ ফুট থেকে ১২ ফুট পানির গভীরতা ছিল; সেখানে এখন ধু-ধু বালুচর। পদ্মা, যমুনা, তিস্তাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের চার শতাধিক নদীর মধ্যে পানির অভাবে ৯০ ভাগ নদীরই করুণ দশা। অধিকাংশ নদীতেই ফসল ফলানো হচ্ছে। ফসলের মাঠ দেখে বোঝার উপায় নেই, এখানে নদী ছিল। পানির অভাবে এমনিতেই মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়ে খরস্রোতা নদীগুলো তার ওপর এখন সেগুলো গ্রাস করে খাচ্ছে বালি ব্যবসায়ীরা।

সূত্রমতে, প্রতিবছর উত্তরাঞ্চলেন বিভিন্ন নদ-নদী থেকে প্রায় সাড়ে ৭০ কোটি ঘনফুট বালি ও ভিটিবালি উত্তোলন করা হচ্ছে। যেসব নদী থেকে বিপুল পরিমাণ এই বালি উত্তোলন করা হচ্ছে সেসব নদীর মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর রংপুর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যুমনা, ধরলা, ঘাঘট, মহানন্দা, দুধকুমার। অন্যদিকে রাজশাহী বিভাগের নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা ছাড়াও মাথাভাঙা, পুনর্ভবা, বারনই, রাণী, কম্পো, করতোয়া, মহানন্দা, গড়াই, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, ভৈরব নদী। এসব নদীতে ২০ থেকে ৩০ ফুট প্রশস্ত ও গভীর করে বোমা মেশিন দিয়ে বালি তোলা হচ্ছে। এতে করে প্রবাহমান নদীগুলো দিন দিন সরু নালায় পরিণত হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  ট্রেনের অগ্রিম টিকিট মিলবে আগামীকাল থেকে

স্থানীয়রা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ নদীতেই অন্তত ১৮ প্রকার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। বালি তোলার কারণে নদীপাড়ের শত শত স্থাপনা যেমন হুমকিতে পড়েছে, তেমনি অপরিকল্পিত খননের কারণে নদীর স্বাভাবিক চরিত্র নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী হওয়ার কারণে অবৈধ বালি ব্যবসায়ীর ভয়ে কেউই মুখ খোলেন না। অন্যদিকে আবার প্রশাসনের হঠাৎ হঠাৎ অভিযান চলার পর অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা কিছুদিন নীরব থেকে ফের উৎসবে মেতে ওঠেন।

প্রতিবছর বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় উত্তরের নদীগুলো। পরে শুকনা মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে জেগে ওঠে ধুধু চর। এসব নদীর বিভিন্ন স্থানে এখন অবৈধ বালুমহাল গড়ে উঠেছে। যেসব মহাল বালুখেকোদের দখলে। স্থানীদের অভিযোগ, প্রশাসনের নীরবতায় নদীর বুক থেকে প্রতিদিন অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকার বালু তুলছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। যেসব বালি জেলার বিভিন্ন স্থানে নির্মাণাধীন স্থাপনা ও খাল ভরাটের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে স্থাপনা নির্মাণকারীরা লাভবান হলেও সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে তেমনি প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে নদীপাড়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্থাপনাগুলো।

অন্যদিকে, নদীর বুক থেকে নির্বিচার বালি উত্তোলনের ফলে উত্তরের নদীর পাশাপাশি পরিবেশ-প্রতিবেশ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় সচেতন সমাজের দাবি, নদীতে সরকারিভাবে বালুমহাল তৈরি করে অবৈধ বালু বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। এটা সম্ভব হলে নদীকেন্দ্রিক বালু উত্তোলন থেকেই রাজস্ব আয় দ্বিগুণ হবে। নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়ে সোচ্চার পরিবেশবাদীরা। তারা বিভিন্ন সময়ে বালি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। কখনও কখনও মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন।

আরও পড়ুনঃ  দুই-তৃতীয়াংশ সড়কের বেহাল দশা

উত্তরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে নদীগুলোতে চলছে বালি বাণিজ্যের উৎসব। কোনো নজরদারি না থাকায় ছোট বড় শত শত নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে শ্যালোমেশিন বসিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। কেউ কেউ আবার শুকনো চর থেকে কোদাল ও বেলচা দিয়ে বালু উত্তোলন করছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি স্থানে মৎস্য প্রকল্পের নামে চলছে খাল খনন। সেখান থেকে মাটি ও বালু উত্তোলন করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে।

রংপুর সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের তিস্তা প্রথম সেতু ও মহিপুরে তিস্তা দ্বিতীয় সড়ক সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেতু থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে শ্যালোমেশিন বসিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালু তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যালোমেশিন মালিক ভুট্টু মিয়া বলেন, মসজিদের কাজের জন্য বালু তোলা হচ্ছে। এটা বিক্রি করা হবে না। আমি তো প্রায় তিন মাস ধরে এখান থেকে বালু উত্তোলন করছি, কেউ তো কিছু বলেনি। তবে মসজিদ নির্মাণে এতো বালি লাগে কি না জানতে চাইলে ভুট্টু মিয়া কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তার দাবি, উপজেলা প্রশাসনের কাছে অনুমতি নিয়েই তিনি বালু উত্তোলন করছেন। পরে সেখানকার লোকেরা জানান, ভুট্টু মিয়া বালু ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন করে আসছেন।

ভুট্টুর মতো অন্তত ৭০ থেকে ৮০ জন অবৈধ বালি ব্যবসায়ী তিস্তা ও ধরলা থেকে বালু উত্তোলন করে আসছেন। যাদের বেশির ভাগই বিভিন্নভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধ ব্যবসা করছে। স্থানীয়দের দাবি, তিস্তা নদীর প্রথম সেতু এলাকার গোকুন্ডা ও দ্বিতীয় ব্রিজের নিচ, ধরলা সেতুর কুলাঘাট, কাকিনা, খুনিয়াগাছ, রাজপুর, হাতিবান্ধার ঘুন্টিরপারসহ শতাধিক পয়েন্ট এলাকায় বালু উত্তোলন হয়ে থাকে। এসব ছাড়াও বেশ কয়েকটি স্থানে মৎস্য প্রকল্পের নামে খাল খনন করে মাটি ও বালু বিক্রি করা হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  পাট কেনায় অনীহা

জানতে চাইলে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল ওয়াহাব ভূঞা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বালু উত্তোলনের দায়ে জরিমানা আদায় অব্যাহত রয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে আসছি। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

ছোট যমুনায় বালি উত্তোলনে কৃষকের কান্না:
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট যমুনা নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে নদীর দুই পাশের উঁচু জমি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ট্রাক-চলাচলের কারণে ধুলাবালি উড়ে গিয়ে জমির ফসলগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এলাকার কৃষকরা বালু উত্তোলনে বাধা সৃষ্টি করলে তাদের পুলিশ দিয়ে তুলে নেয়ার হুমকি দেন বালি ব্যবসায়ীরা। এমন কি যেসব কৃষক বালু উত্তোলনে বাধা দেবে তাদের মারধরসহ মামলার হুমকিও দেয়া হচ্ছে।

কৃষক রবিউল ইসলাম জুয়েল বলেন, তার জমির পাশে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করায় নদীর পাশে বিশাল বাঁশঝার ও কয়েকটি মেহগুণি গাছসহ জমিটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন বলেন, এসব বিষয়ে অভিয়োগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। নওগাঁ জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, কিছু কৃষক ছোট যমুনা নদীর বালু মহালের বালু উত্তোলন নিয়ে অভিয়োগ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন