শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সমুদ্র বাণিজ্যে মাইলফলক

সমুদ্র বাণিজ্যে মাইলফলক

দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের সঙ্গে ইউরোপের কনটেইনার জাহাজ চলাচল শুরু হতে যাচ্ছে। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে থেকে প্রায় ১১০০ টিইইউএস (টুয়েন্টি ফুট ইকুয়েভিলেন্ট ইউনিট) রফতানি পণ্য নিয়ে ইতালির রেভনা বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে এই রুটের প্রথম জাহাজ- সোঙ্গা চিতা। জাহাজটি মাঝপথে কোনো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে না থেমেই মাত্র ১৫ দিনে ইতালির ‘সিভিটাভিসিয়া’ সমুদ্রবন্দরে পৌঁছবে।

স্বাভাবিকভাবে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর-কলম্বো হয়ে ইউরোপ যেতে সময় লাগছে ২৪-২৬ দিন। নতুন সেবায় সময় সাশ্রয় হবে ১০ দিন। আর কোনো বিরতি ছাড়াই রফতানি পণ্য ইউরোপের বন্দরে পৌঁছবে। প্রাথমিকভাবে দুটি জাহাজ ২৫ দিন পর পর চট্টগ্রাম থেকে রফতানি পণ্য পরিবহন করবে। এতে শিপিংয়ের খরচ ও সময় দুইই কমবে। খরচ কমবে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরো দৃঢ় হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

বর্তমানে বিভিন্ন ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে যেমন- সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং, শ্রীলঙ্কার কলম্বো পোর্ট হয়ে ইউরোপ পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৪০ দিন। নতুন রুটে জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় পণ্য পৌঁছাতে সময় কমবে ২৫ দিন। ব্যয় কমবে প্রায় ৪০ শতাংশ। এতে সময় সাশ্রয় হবে, খরচ কমবে বলে আশা রফতানিকারকদের।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে দুটি কনটেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম-ইতালি রুটে চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে মাসে দুটি জাহাজ চলাচল করবে, গ্রাহক সাড়া পেলে পরবর্তীতে সেটি বাড়বে। চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপে সরাসরি কনটেইনার জাহাজ সার্ভিস এটিই প্রথম। নতুন সার্ভিসে মাঝপথে জাহাজকে থেমে পণ্য নামিয়ে আরেক জাহাজে তুলতে হবে না। আর সময় কম লাগবে অন্তত ১০ দিন। পরিবহন ভাড়াও কম লাগবে। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা ছয় মাসের জন্য এই সার্ভিসের অনুমোদন দিয়েছি। আমরা চাই অন্য কোম্পানি ইউরোপ রুটে সরাসরি জাহাজ সার্ভিস চালু করুক। এতে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোর জট নিয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ অনেকটাই কমবে।’

ইতালিয়ান শিপিং কোম্পানি ক্যালিপসো কোম্পাজনিয়া ডি নেভিগ্যাজোনে এসপিএ দুটি কনটেইনার জাহাজ- সোঙ্গা চিতা ও কেপ ফ্লোরেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের রফতানি পণ্য পরিবহন করবে। কেপ ফ্লোরেস জাহাজটি মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী জাহাজ। এটির ড্রাফট ৮ দশমিক ৬৬ মিটার। কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ১,২০০ টিইইউএস। দৈর্ঘ্য ১৫৪ দশমিক ৪৭ মিটার এবং প্রস্থ ২৫ দশমিক ১৯ মিটার। রফতানি পণ্য পরিবহনের জন্য সোঙ্গা চিতা জাহাজটি বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের পথে রয়েছে। লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী ৬ দশমিক ২ মিটার ড্রাফটের এই জাহাজটি আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে। বাংলাদেশে জাহাজ দুটির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস।

আরও পড়ুনঃ  এসএসসি ও সমমানে পাসের হার ৮০.৩৯

রিলায়েন্স শিপিং এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাশেদ বলেন, সোঙ্গা চিতা জাহাজটি ইতালির রেভেনা বন্দর থেকে ৯৪৫ টিইইউএস খালি কনটেইনার এবং ৭ টিইউউএস গার্মেন্টসের কাঁচামাল নিয়ে গত ১৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। এটি আজ ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে। বন্দরে পৌঁছানোর পর সরাসরি বার্থিং পেলে কনটেইনার বোঝাই করে ৭ অথবা ৮ ফেব্রুয়ারি ইতালির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, জাহাজটিতে ১১০০ টিইউএস কনটেইনার ১৬ হাজার ৫০০ টন রফতানি পণ্য বহন করবে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ তৈরি পোশাক এবং বাকি ২ শতাংশ হ্যান্ডিক্রাফট ও চামড়া, পাট জাতীয় পণ্য। পণ্যগুলো রেভেনা বন্দরে পৌঁছানোর পর সেগুলো ক্রেতাদের চাহিদামতো ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। এর আগে, কেপ ফ্লোরেস খালি কনটেইনার নিয়ে ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। কিন্তু ফিরতি পথে এটি কোনো রফতানি পণ্য বহন করেনি।

বর্তমানে ইতালিভিত্তিক কনটেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের রটারড্যাম, অ্যান্টওয়ার্প ও হামবুর্গের মতো মূল বন্দরে (বেজপোর্ট) যাওয়ার আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি কনটেইনার জাহাজ চলাচল করে মূলত সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কার কলম্বো, মালয়েশিয়ার তানজুম পেলিপাস ও কেলাং এবং চীনের কয়েকটি বন্দরের মধ্যে। এসব বন্দর হয়ে রপ্তানি পণ্য ইতালিসহ ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে যায়। কিছু ক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর থেকে মাদারভ্যাসেলে মাল বোঝাই করে ইতালি পর্যন্ত পরিবহন করা হলেও, মাদারভ্যাসেল না থাকলে বেশিরভাগ সময়ে ইউরোপীয় মূল বন্দরে কন্টেইনার আনলোড করা হয়। সেখান থেকে আবার ফিডার জাহাজে তা ইতালি পাঠাতে হয়।

একইভাবে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার এসব দেশের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়। এ ছাড়া ভারতের কয়েকটি বন্দরে অনিয়মিত কনটেইনার পরিবহন সেবা রয়েছে। মূলত চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ না থাকায় বিশ্বের বড় বড় বন্দরের সঙ্গে কনটেইনার জাহাজ চলাচল করেনি। এখন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ও সময় বেশি লাগায় ছোট জাহাজে কনটেইনার পরিবহনে সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুনঃ  বাজারে চাল-ডাল, তেলের দাম বাড়তি

শিপিং ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে এখন কনটেইনার ও জাহাজ ভাড়া রেকর্ড ছুঁয়েছে। এই অবস্থায় ছোট এই জাহাজ দিয়ে সার্ভিস চালু করায় প্রতি কনটেইনারে অন্তত পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে। বর্তমানে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট থেকে ইতালিতে একটি ৪০ ফুটি কনটেইনার জাহাজ পরিবহনের ভাড়া শিপিং লাইনের ওপর নির্ভর করে ১০-১৪ হাজার ডলারের মধ্যে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, নতুন রুটে মালবাহী চার্জ ৬-৭ হাজার ডলার হতে পারে।

দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। কনটেইনার শিপমেন্টের ৯৮ শতাংশও হয় এখানেই। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ রফতানির গন্তব্যই হলো ইউরোপ। তবে জাহাজের সময়সূচি অনুযায়ী বন্দরে পণ্য পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে রফতানিকারকরা অনেক সময় আকাশপথে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হন। এতে পরিবহন খরচ বহুগুণ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রমতে, দেশের সামগ্রিক রফতানি বাণিজ্যের ৫৫ শতাংশই হয় ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে। বাংলাদেশের মোট রফতানির প্রায় ৮২ শতাংশ পোশাক পণ্য। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১.২৭ লাখ টিইইউ রফতানি কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। যার মধ্যে শুধু ইউরোপে যায় ৫৭,২০০ টিইইউ কনটেইনার।

বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ফিডার ভ্যাসেলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে পণ্য পৌঁছাতে একদিন দেরি হলেও মাদারভেসেল মিস করার আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় মাদারভেসেলের শিডিউল পেতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য না নিয়েও ফিডার জাহাজ চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে নির্দিষ্ট সময়ে গ্রাহকদের কাছে পণ্য পাঠানো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ বাস্তবতায় ইউরোপের সঙ্গে নতুন জাহাজ চলাচলের পথ দেশের রফতানি খাতে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। ব্যবসায়ীরা ইউরোপ ও আমেরিকার অন্যান্য বন্দরে সরাসরি কনটেইনার জাহাজ চলাচলের জন্য কর্তৃপক্ষকে আরও রুট তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটি বড় অর্জন। ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি পণ্য পরিবহন দেশের রফতানি খাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এই সেবা যাতে ব্যাহত না হয় তা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  ১ জুনের মধ্যে ঢাবি না খুললে কফিন নিয়ে মিছিল

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে ইউরোপে পাঠানোর সময় পণ্য লোড, আনলোড, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের স্টোর চার্জসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বহন করতে হয়। সরাসরি পরিবহনের কারণে বিশাল অংকের টাকা বেঁচে যাবে। পণ্য পরিবহন ব্যয় কমে যাওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা লাভবান হবে। এটি নতুন ক্রেতা সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, এই রুটে পরীক্ষামূলক শিপিং ইতোমধ্যেই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই উদ্যোগ জাহাজের স্থায়ী পরিচালন ব্যয়সহ রফতানি-আমদানি বাণিজ্যে খরচ কমিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করবে। তাই এই রুটটি জনপ্রিয় হলে দেশের রপ্তানিখাতে একটি নতুন মাইলফলক তৈরি হবে জানিয়ে তারা বলেন, এতে নতুন ক্রেতা আকৃষ্ট হবে এবং দেশের রফতানি খাত প্রসারিত হবে।

বাংলাদেশ থেকে পোশাক রফতানিতে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া ঠিক করেন বিদেশি ক্রেতারা। ফলে এখন বাড়তি ভাড়ার টাকা তাদের পকেট থেকেই যাচ্ছে। এই অবস্থায় ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠান ‘আরআইএফ লাইন’ এবং এটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ক্যালিপসো কম্পানিয়া ডি নেভিগেশন’ নতুন এই কনটেইনার জাহাজ সার্ভিস চালু করেছে। মূলত ইতালির ক্রেতাদের সহযোগিতায় ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানটি এই সেবা চালু করেছে।
এই উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি সুফল পাবে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প। কারণ বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ৬০ শতাংশ ইউরোপের দেশগুলোতে যায়।

বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বৃহত্তম বাজার ইউরোপ। নতুন রুটে অর্ধেক সময় কমবে যা দেশের রফতানি খাতের জন্য খুবই ইতিবাচক সংবাদ। তিনি বলেন, কয়েক মাস আগেও ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোর জাহাজজটের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলাম। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তখনই আমরা চট্টগ্রাম-ইউরোপ সরাসরি জাহাজ সার্ভিস চালুর দাবি জানিয়েছিলাম। সেই দাবিতে এগিয়ে এসেছেন এক উদ্যোক্তা। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। কারণ ক্রেতারা দ্রুত পণ্য নিতে চান। এই উদ্যোগ সফল হলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে দেশের পোশাকশিল্প।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন