দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামে। কৃষক শের আলী মাত্র শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ জমিতে ফুল চাষ করেছিলেন। সেই শুরু। এখন ফুলের এ বাণিজ্যিক চাষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে জেলা থেকে জেলায়। যশোর থেকে এখন ২৪ থেকে ২৫ জেলায় চলছে ফুলের বাণিজ্যিক চাষ। করোনার আগে পর্যন্ত ফুলের বাজার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছিল। করোনার কারণে ফুল চাষে অনেকেই লোকসানের মুখে পড়েছেন।
আগে শুরু বিয়ের আয়োজনে ফুলের প্রয়োজন হতো। অন্যসব জায়গায় ফুলের ব্যবহার হতো সামান্যই। তবে, চিত্র পাল্টেছে এখন। ভালোবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, দেশব্যাপী ব্যাপক আয়োজনের মধ্যে দিয়ে পালন করা হয়। এসবের পাশাপাশি পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠান যেন ফুল ছাড়া চলেই না। অনেক মানুষ এখন ঘরেও তাজা ফুল রাখতে পছন্দ করে। ফুলের চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে বলেই বাড়ছে ফুলের বাজার।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজার অবকাঠামো, সংরক্ষণ ও পরিবহন সুবিধার মাধ্যমে ফুল বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের সহকারী পরিচালক রশিদুল ইসলামের করোনার আগে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩,৫০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল উৎপাদনে জড়িত আছেন প্রায় ১৫ হাজার কৃষক এবং ফুল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায়ে অন্তত দেড় লাখ মানুষ সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। ফুল সেক্টরের কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ।
দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফুল উৎপাদন হয় খুলনা বিভাগে। খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ২৬০০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়। যা মোট ফুল উৎপাদনের ৭৪ শতাংশ। এরপরে ঢাকা বিভাগ ৬৯০ হেক্টর। মোট ফুল উৎপাদনের ২০ ভাগ। চট্টগ্রাম বিভাগ ১২১ হেক্টর, যা মোট উৎপাদনের ৩ দশমিক ৪৪ ভাগ। এছাড়া রংপুর বিভাগে ৪২ হেক্টর, যা মোট উৎপাদনের দশমিক ২৯ শতাংশ। এখন রাজশাহী বিভাগের বেশকিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ফুল উৎপাদন হচ্ছে।
রাজশাহীর জয়পুরহাট উপজেলার ভিটি মণ্ডলপাড়া এলাকায় ১৪ বিঘে জমিতে ফুলের বাগান গড়ে তুলেছেন আবু তালেব মণ্ডল জাকারিয়া। সেখানে তিনি রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদাসহ অনেক ধরনের ফুল চাষ করেছেন।
ফুল চাষি আবু তালেব মণ্ডল জাকারিয়া বলেন, ফুলের ব্যবসা আমি ছোট থেকেই করি। প্রথমে ফুল যশোর ও খুলনা এলাকা থেকে পাইকারি দরে ফুল কিনে নিয়ে আসতাম। এরপরে ধীরে ধীরে ফুল চাষের কথা চিন্তা আসে। ১৪ বিঘা জমিতে ফুল চাষ করে বেশ আয় হবে বলে আশা করছি। জয়পুরজহাটসহ রাজশাহী বিভাগের বেশ কয়েক জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ শুরু হয়েছে।
ফুল রফতানি করেও প্রচুর আয় করা সম্ভব। ১৯৯১-৯২ বছর থেকে ফুল রফতানির জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্রমতে, ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরের ১২ হাজার টাকা, ১৯৯৪-৯৫ সালে ১৬ হাজার টাকা ফুল রপ্তানি হলেও ২০০৫ সালে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪০০ কোটিতে দাঁড়ায়। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এদেশ থেকে ফুল রফতানি হয়েছিল ২৭৬ কোটি ৯ লাখ টাকা, ২০০৯-২০১০ সালে ৩২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং ২০১০-২০১১ সালে ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এসংখ্য পরের দশকে আরো বেড়েছে।
বাংলাদেশের কাঁচা ফুল মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত, ইতালি, কানাডা, চীন, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সে রফতানি করা হচ্ছে। বিশ্বে ১৬ হাজার কোটি ডলারের বিশাল ফুলের বাজারে আরো বড় আকাড়ের রফতানি প্রবেশের সুযোগ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্যে। তবে উদ্যোক্তাদের অভিমত, কাঁচা ফুল রফতানি করে ৫০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজার অবকাঠামো, সংরক্ষণ ও পরিবহন সুবিধার মাধ্যমে ফুল বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের সহকারী পরিচালক রশিদুল ইসলাম বলেন, করোনার আগেই বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ফুল শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে করোনা মহামারীর কারণে ফুল বাণিজ্যেও মহামারী হয়েছে। ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ীদের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। করোনাকালে ফুল চাষতো বন্ধ ছিল না। অথচ ফুল বিক্রির জায়গা সীমিত হয়ে পড়ায় ফুল চাষিদের যেমন পানির দামে ফুল বিক্রি করতে হয়েছে, আবার ফুল ব্যবসায়ীরা সে ফুল কিনে বিক্রি করতে না পেরে লোকসানের মুখে পড়েছে।
আনন্দবাজার/শহক