শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আধুনিকায়নে লবণশিল্প

আধুনিকায়নে লবণশিল্প

হাজার হাজার বছর আগে খনি থেকে লবণ উত্তোলনের কৌশল শিখে নিয়েছিল মানুষ। তখন সাগরের পানি পরিশুদ্ধ করে প্রক্রিয়াজাত লবণের ব্যবহার ছিল না। চীনের সানশি প্রদেশের ইয়নচুনে প্রথম লবণ খনির তথ্য পাওয়া যায়। যেটা এখন অবধি সবচেয়ে প্রাচীন খনি, যেখানে মাটি খুঁড়ে লবণ বের করা হতো। বর্তমানে তুরস্ক, বলিভিয়া, পোল্যান্ডসহ অনেক দেশে লবণের খনি দেখা যায়। তবে সাগরের পানি পরিশুদ্ধ করে সংগ্রহ করা লবণের ওপর ভিত্তি করেই এখন দেশে লবণশিল্প গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে লবণশিল্পের প্রসারের ইতিহাস বহু প্রাচীন।

বিভিন্ন উৎসের সূত্রমতে, প্রাচীনকাল থেকেই উপমহাদেশে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে লবণচাষের প্রসার ঘটে। চট্টগ্রামে ‘মুলঙ্গী’ নামে জনগোষ্ঠী সাগরের পানি সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করতো। মুগল আমলে এই শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতো ‘নিমক জায়গীর মহাল ও নিমক এয়জ মহাল’ নামে দুটি সরকারি বিভাগ। যাদের অধীনে ছিল ৩৯টি লবণ সংগ্রহ ক্ষেত্র বা তোফল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ষোড়শ শতকে সরকারিখাতে মাশুল দিতে হতো লবণ উৎপাদনকারীদের। মুগল আমলে লবণ শিল্পের ব্যবস্থাপনা ছিল জমিদার শ্রেণির হাতে। ১৭৫৭-৬৫ সালের মধ্যে অনেক ইংরেজ লবণ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল।

তবে লবণের ইতিহাস যে শুধু খাওয়া, ব্যবহার বা বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রাচীন রোমে সৈন্যদের বেতন দেয়া হতো লবণ দিয়ে। সেনা আর সেলারি হিসেবে ইংরেজিতে ‘সোলজার’ শব্দটি এসেছে মূলত ‘সল্ট’ থেকে। আজ যে সালাদ খাওয়া হয় সে শব্দটিও এসেছে সল্ট থেকে সল্টেড হয়ে। লবণের ওপর ব্রিটিশ সরকার যে কর আরোপ করেছিল তারই প্রতিবাদে ভারতে রীতিমতো আন্দোলন হয়েছিল। যাকে লবণ আইন অভিযান বা লবণ সত্যাগ্রহ বা ইংরেজি যা ‘সল্ট মার্চ’। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ মর্যাদার এই লং মার্চের আহ্বায়ক ছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। লক্ষ লক্ষ মানুষ গান্ধীজির যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  কৃষকদের ২৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে ব্যাংক

শুধু রাজনীতি বা আন্দোলনেই নয়, অনেক ধর্মেও লবণ খুব পবিত্র ব্যাপার। জাপানের শিন্টোরায় যে কোনো মানুষ বা স্থানকে পরিশুদ্ধ করতে লবণ ছিটিয়ে দেয়া হয়। এ জন্যই সুমো কুস্তীগিরদের ওপরও ছিটিয়ে দেয়া হয় লবণ। লবণ শুধু যে কল্যাণই বলে এনেছে মানব জাতির তা কিন্তু নয়। ইতালির ভেনিস শহরের সঙ্গে জেনোয়া নামের আরেকটি শহরের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল শুধু লবণকে কেন্দ্র করেই।

বাংলায় নতুন উদ্যমে লবণ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর। তবে লবণশিল্পের ওপর অতিরিক্ত আবগারি শুল্ক আরোপ করে শিল্পের প্রসারকে সংকুচিত করে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকরা। একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশে লবণশিল্পের ব্যাপক প্রসার হয়। লবণশিল্পকে আরো এগিয়ে নিতে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্য দিয়েই উপকূলীয় অঞ্চলের লবণশিল্পের আধুনিকায়ন শুরু হয়।

পরবর্তী পর্যায়ে লবণ উৎপাদন প্রক্রিয়া সনাতনি পদ্ধতির পরিবর্তে আরো সহজ ও আধুনিক করার জন্য ২০০১ সালের দিকে পলিথিন মাটিতে বিছিয়ে লবণ উৎপাদনের কৌশল শিখিয়ে দেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন এই প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত হয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ লবণচাষে ব্যাপক আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৩৫ শতাংশের বেশি আন্তর্জাতিক মানের লবণ উৎপাদন হতে থাকে। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানির সুযোগ তৈরি হয়।

সূত্রমতে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ঘিরে গড়ে ওঠা বৃহৎ লবণশিল্পকে আরো আধুনিকায়ন করার চেষ্টা চলছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ছাড়াও খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় প্রসার ঘটে লবণশিল্পের। এতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। লবণশিল্প উপকূলের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রেখে যাচ্ছে। এক হিসাবে, লবণখাত প্রতিবছর গড়ে প্রায় দেড় হাজার কোট টাকার অবদান রাখছে। তবে অভিযোগও কম নয়। লবণচাষিরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ তাদের। তাছাড়া লবণশিল্প ঘিরে তাদের অনেক দাবিও পূরণ করা হচ্ছে না বলেও বিভিন্ন সময় তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে।

আরও পড়ুনঃ  রপ্তানি বাণিজ্য ৮০ বিলিয়নে উন্নীত করার চিন্তা-অর্থমন্ত্রী

লবণচাষিদের সুরক্ষা ও শিল্পের উন্নয়নে গত কয়েক বছর ধরেই লবণ বোর্ড গঠন করার কথা বলা হচ্ছে। তবে আজও সে বোর্ড গঠন করা হয়নি। গেল ২০১৯ সালে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে লবণ চাষিদের সুরক্ষা এবং লবণশিল্পের উন্নয়নে কক্সবাজারে লবণ বোর্ড গঠন করার কথা জানিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। এরপর ২০২০ সালে শিল্পমন্ত্রী বলেছিলেন, লবণকে শিল্পপণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে উপযোগিতা যাচাইবাছাই করে কক্সবাজারে লবণ বোর্ড গঠন করার কথা জানান। যে বোর্ডে লবণশিল্প সংশ্লিষ্ট সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। যার মাধ্যমে লবণশিল্পের আধুনিকায়ন ও লবণচাষিদের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথাও জানান। তবে এখনও লবণ বোর্ড গঠন হয়নি।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন