শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সার্কুলার ইকোনমিতে গুরুত্ব, গঠিত হচ্ছে সেল

সার্কুলার ইকোনমিতে গুরুত্ব,

এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর দেশের টেকসই উন্নয়নের ধারা চলমান রাখতে সার্কুলার ইকোনমি মডেল অনুসরণ করে কাজ করতে হবে। এর জন্য যথাযথ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি

: শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহার বাড়ছে। পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু, বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। শঙ্কা তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের। আগামী প্রজন্মের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র সুরক্ষা, বর্জ্য ও দূষণ রোধ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেলে উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধন হয়। পণ্য ব্যবহারের পর বর্জ্য সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ কমে, দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায় পরিবেশ। তাই টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের কার্যকর হাতিয়ার হচ্ছে সাকুর্লার ইকোনমি।

সার্কুলার ইকোনমি হচ্ছে এমন একটি উৎপাদন বা ব্যয় মডেল যেখানে পণ্য ও উপকরণগুলো পুর্নব্যবহার, পুর্ণনির্মাণ,পুনরুদ্ধার, মেরামত ও হালনাগাদ করা এবং বিদ্যমান সামগ্রি ও পণ্যগুলোকে যতদূর সম্ভব অর্থনীতিতে বজায় রাখার একটি পরিকল্পনা। এটি মূলত পণ্যের জীবনচক্রকে দীর্ঘায়িত করে। এর বাস্তাবায়নের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ সম্পদ আহরণের পরিমাণ হ্রাস পায়। বর্তমান বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর এ মডেলের অর্থনীতি অনুসরণ করে বর্তমান অবস্থায় এসেছে।

গতকাল রবিবার ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস্ অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে সার্কুলার ইকোনমির বর্তমান অবস্থা: সমস্যা ও সামাধান’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই ভবন অডিটোরিয়ামে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর দেশের টেকসই উন্নয়নের ধারা চলমান রাখতে বাংলাদেশকে সার্কুলার ইকোনমি মডেল অনুসরণ করে কাজ করতে হবে। এর জন্য যথাযথ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি।

আরও পড়ুনঃ  ভাষা শহীদদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির বিনম্র শ্রদ্ধা

এফবিসিসিআই’র প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সুজাউদ্দিন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক, আইসিসিসিএডির উপপরিচালক অধ্যাপক ড. মিজান আর খান, ন্যাচারাল রিসোর্স এন্ড ব্লু ইকোনমি গ্লোবাল প্রাকটিসের সিনিয়র পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মিসেস ইয়ান জু আলিসন ই এবং আইএফইএস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন পিএইচডি এবং এফবিসিসিআইয়ের প্যানেল উপদেষ্টাবৃন্দ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী বলেন, পৃথীবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে আমাদের সার্কুলার ইকোনমির গুরুত্ব অনেক। বর্ধিত নগরায়নের সঙ্গে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। শিল্প বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য, প্রাণীজ বর্জ্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে বায়ু, পানি, মাটি ইত্যাদি। এর প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। পড়ছে জলবায়ুর ওপর প্রতিকূল প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন প্রাণীর জটিল ও কঠিন রোগ দেখা দিচ্ছে। পরিবেশের ওপর জলবায়ুর প্রভাবের জন্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত, খাদ্যাভাবজনিত রোগসহ নানা জটিল ও অপরিচিত রোগ দেখা দিচ্ছে।

সেমিনারে সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এক শিল্পের বর্জ্য অন্যশিল্পের জন্য উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন, ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর সেজন্য সার্কুলার ইকোনমির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। দেশে নির্মাণ শিল্প, টেক্সটাইল, মোটর গাড়ি, লজিস্টিকস, কৃষি, আসবাব, তেল ও গ্যাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানিখাতকে সার্কুলার ইকোনমিতে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু বার্ষিক প্লাস্টিক ব্যবহার মাত্র ৭ থেকে ৮ কেজি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ পরিমাণ ১৩০ কেজি। পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুণরায় সম্পদে রূপান্তর করছে দেশটি।

আরও পড়ুনঃ  শিগগিরই চালের দাম কমবে: কৃষিমন্ত্রী

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ুমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন আহমেদ জানান, বর্তমানে ৪০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। বাকি ৬০ শতাংশকেও এর আওতায় আনতে হবে। এজন্য প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ওয়ার্কিং পেপার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সুজাউদ্দিন জানান, যেহারে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার হচ্ছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যে মূল্যবান বিভিন্ন খনিজের মজুদ শেষ হয়ে যাবে। তবে পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশের বৃত্তাকার অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা আছে বলে জানানো হয় মূল প্রবন্ধে। দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বাড়ছে। এই খাতকে শিল্প হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে দেশের সার্কুলার ইকোনমির বিকাশ আরো গতিশীল হবে।

সেমিনারে আইসিসিসিএডির উপপরিচালক অধ্যাপক ড. মিজান আর খান বলেন, ঢাকার উন্নয়নে জীবনমানের উন্নতি হচ্ছে না। আগামী প্রজন্ম তাদের বাসার মধ্যে পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না। আমেরিকা থেকে ৬৫ ভাগ ছোট এ দেশে আমেরিকার প্রায় অর্ধেক মানুষের বসবাস। ফলে এখানে সার্কুলার ইকোনমি নিয়ে কাজ করতে হবে। ভারতের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রফেসররা কয়েক বছরের জন্য কাজ করে থাকেন। তবে আমাদের দেশে এ ধরণের কোনো সুযোগ নেই। এফবিসিসিআইকে প্রফেসরদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

গ্রুপ আলোচনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, এখানে আমরা গবেষণা করার জন্য কারখানা থেকে পর্যাপ্ত তথ্য পাই না। অনেকে তথ্য দিতে চান না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তাছাড়া প্রাইভেট সেক্টর, কারখানা, সরকার ও গবেষকদের মধ্যে নেটওয়ার্কের অনেক গ্যাপ আছে বলেও মন্তব্য করেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা এ গবেষক।

আরও পড়ুনঃ  সরকারি জিনিসকে নিজের মনে করে যত্ন নিন: প্রধানমন্ত্রী

সেমিনারে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, রিসাইকেল ইন্ড্রাস্ট্রিকে সরকারের পক্ষ থেকে শিল্প হিসেবে ঘোষণারে দাবি জানান। এতে করে এ শিল্প ব্যাংক সাপোর্ট পাবে। তাছাড়া এতে করে এ শিল্পকে একটি কাঠামোতে নিয়ে আসা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন।

সেমিনারে আরো উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সহ-সভাপতি মো. আমিন হেলালী, মো. হাবীব উল্লাহ ডনসহ অন্যান্য পরিচালকবৃন্দ। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআই’র মহাসচিব মাহফুজুল হক।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন