শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দক্ষিণে শিল্পের স্বপ্ন

দক্ষিণে শিল্পের স্বপ্ন

বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগার বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পলি জমে ওঠা কয়েকটি দ্বীপ ঘিরে গড়ে উঠেছে বাংলার ভেনিসখ্যাত বরিশাল। প্রাচীনকাল থেকেই নদীভাঙন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই করছেন কীর্তনখোলার তীরে ধান-নদী খালের অপূর্ব সমাহার এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। এক সময়ের বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত বরিশাল দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জেলা এবং বিভাগীয় সদর দফতর। কৃষি ও মৎস্য শিকার প্রধান পেশা হওয়ায় দেশের খাদ্যশস্য ও মৎস্য উৎপাদনের অন্যতম মূল উৎস হয়ে আছে বরিশাল।

তবে খাদ্যশস্য ও মৎস্যের জোগান দেয়া দক্ষিণাঞ্চলের এ জনপদ ঘিরে বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি বিগত অর্ধশতক ধরেও। ধান-নদী-খালের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়নি আজও। শুধু দুই-চারটি প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের বাইরে কবি জীবনানন্দের বরিশালে নেই কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। গ্যাস যেমন নেই তেমনি বিদ্যুতের ঘাটতিও প্রবল। যোগাযোগের একমুখী ব্যবস্থায় ভারী শিল্প তো নয়ই, এমনকি সাধারণ শিল্পকারাখানাতেও অন্যান্য বিভাগের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বরিশাল।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, উদ্যোক্তা, সস্তা শ্রম ও জমি থাকার পরও এই জেলায় ভারী কিংবা মাঝারি শিল্পখাতে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। এমনিতেই শিল্পে পিছিয়ে রয়েছে তার ওপর আবার প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলটিও আপাতত হচ্ছে না বরিশালে। এজন্য যে জমির প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা বিনিয়োগের জন্য উপযোগী মনে করছে না বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। ফলে বরিশালে সরকারিভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ঝুলে গেছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, বরিশাল বিভাগে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করার দিকে সরকার কখনও নজর দেয়নি। দেশের অন্যসব জেলায় রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) যেমন চালু হয়েছে তেমনি নতুন করে অর্থনৈতিক অঞ্চলও হচ্ছে। তবে এসবের কোনো কিছুই হচ্ছে না বরিশালে। এমনকি বরিশালে যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগর আছে, সেটিও চরম অবহেলিত।
শিল্পের প্রসার না হওয়ায় বরিশালের তরুণদের কর্মসংস্থানের সন্ধানে যেতে হয় দেশের অন্যান্য জেলায়।

আরও পড়ুনঃ  শৈত্যপ্রবাহ থাকতে পারে আরও দুইদিন

এদিকে, দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ভোলায় প্রাকৃতিক গ্যাসের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পকারাখান গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলায় প্রাকৃতিক গ্যাসের যে মজুদ রয়েছে তা ভবিষ্যতে মোট মজুদের প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে। অনেকেই বলছেন, গ্যাসে ভাসছে ভোলা। এই গ্যাস উত্তোলন করা হলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, তেমনি বিপুল সংখ্যক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন লিমিটেডের (বাপেক্স) অনুসন্ধানে বিদায়ী বছরে জেলার আলাদা তিনটি স্থানে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব কূপের খনন শুরু হলে জেলায় সর্বমোট কূপের সংখ্যা দাঁড়াবে নয়টিতে। এসব কূপের গ্যাসে বদলে যেতে পারে শিল্পের চেহারা।

সূত্রমতে, বরিশালে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ধরলে একমাত্র অপসোনিনের ওষুধ কারখানা রয়েছে। আর অন্যটি খান সন্সের সিমেন্ট মিল। এর বাইরে বিসিকে ফরচুন সুজ নামের রফতানিমুখী জুতার কারখানা আর ইলেকট্রিক সামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদী ইলেকট্রিক ওয়্যারস অ্যান্ড মাল্টি প্রোডাক্টস (এমইপি) লিমিটেড। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য বৃহৎ বা মাঝারি কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই। বরিশালে শিল্পপ্রতিষ্ঠান না থাকায় নতুন নতুন কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগও নেই। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের প্রবণতা হচ্ছে, তরুণ-তরুণীরা কর্মক্ষম হলেই তাদের ছুটতে হয় রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্য কোনো শহরে।

তবে পটুয়াখালীতে পায়রা বন্দর আর পদ্মা সেতু ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বরিশালের মানুষ। পায়রা বন্দর চালু হলে আর পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে বদলে যেতে পারে বরিশালের চিরচেনা রূপ। গ্যাস সংযোগ দেয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুততর হলে এখানে গড়ে উঠতে পারে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র। এতে যেমন শিল্পায়ন ঘটবে তেমনি কর্মসংস্থানও বাড়তে থাকে। এমন স্বপ্নই দেখছেন এখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।

আরও পড়ুনঃ  ক্রেতাশূন্য ৩২ কোম্পানির শেয়ার

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারিতে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগে ৪৫ হাজার ৭৩৫টি উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক ইউনিট আছে, যা সিলেট ছাড়া বাকি বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে সিলেট বিভাগে গ্যাস থাকায় সেখানে অনেক বড় বড় শিল্প হয়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে বেজা। তবে এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বরিশাল অঞ্চল।

সূত্রমতে, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে একটি হওয়ার কথা ছিল বরিশাল জেলায়। এ জন্য আগৈলঝাড়া উপজেলায় আগৈলঝাড়া-গোপালগঞ্জ সড়কের পাশে প্রায় ৩০০ একর জমি নির্বাচন করেছিল জেলা প্রশাসন। এ জমি জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নির্বাচনী এলাকার মধ্যে পড়েছে। অবশ্য এ জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বাতিল করা হলেও নতুন জমি ঠিক করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে বরিশাল জেলা প্রশাসনকে।

বেজা সূত্রমতে, বরিশালে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আপাতত বেজার অগ্রাধিকারে নেই। প্রথম পর্যায়ে কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। তখন বরিশালের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

বরিশাল জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, বেশ কয়েকটি কারণে আগৈলঝাড়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি বাতিল করা হয়েছে। প্রথমত বরিশালে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য এমন জায়গা বাছাই করা হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা কঠিন হবে। কারণ ওই জমি অনেক নিচু। মাটি ভরাট করতে সেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে। যোগাযোগব্যবস্থাও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য অনুকূল নয়।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, তারা নতুন একটি জায়গা ঠিক করে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে। নতুন জায়গা ঠিক করা হয়েছে উজিরপুর উপজেলার জয়শ্রী এলাকায়। এটি ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, ওখানে প্রায় ২০০ একর জমি আছে।

আরও পড়ুনঃ  বৃহৎশিল্পে বড় ঝুঁকি

বিসিক বরিশাল জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বড় ও মাঝারি শিল্প আছে ১৫টি। ক্ষুদ্র শিল্প আছে এক হাজার ৯৫৫টি। কুটির শিল্প আছে ৯ হাজার ৭১৯টি। বরিশালে যে রফতানিমুখী শিল্প কারখানা চালানো যায়, তা প্রমাণ করেছে ফরচুন সুজ। ২০১২ সালে বরিশালের বিসিক শিল্পনগরে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এতে তৈরি জুতা রফতানি হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

ফরচুন সুজের কারখানা ঘুরে এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কারখানার কাঁচামাল সবই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। আবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই জুতা ইউরোপে যায়। তারা মূলত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্পোর্টসওয়্যার তৈরি করেন। ফরচুনের কর্মকর্তারা বলেন, পায়রা বন্দর চালু হলে তাদের কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রফতানিতে সময় কম লাগবে।

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু আনন্দবাজারকে বলেন, সরকার দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে পায়রা সেতুর নির্মাণকাজ শেষে সেটি চালু হওয়ায় পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সঙ্গে বিভাগীয় শহরের দূরত্ব কমেছে, সহজ যাতায়াতের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনেও এসেছে স্বস্তি। পায়রা বন্দর চালু হলে এই অঞ্চলে পণ্যের কাঁচামাল পরিবহন আরও সহজ হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে বরিশালে পণ্য তৈরি করে তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠাতে সমস্যা দূর হবে। এতে বরিশালে বিনিয়োগ বাড়বে।

বিসিসিআইয়ের সভাপতি রিন্টু আরও বলেন, ভোলায় প্রচুর গ্যাস পাওয়া গেছে। সেখান থেকে তা বরিশালে আনা গেলে এই অঞ্চলে প্রচুর বিনিয়োগ হবে। কিন্তু ভোলার নেতারা এই গ্যাস বরিশালে দিতে চাইছেন না। আমরা এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সুনজর চাই।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন