শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নৌপথে বাড়ছে বাণিজ্য

নৌপথে বাড়ছে বাণিজ্য

জ্বালানি তেলের দাম আর আকাশ পথে ভাড়া বাড়ায় বিশ্বব্যাপি নৌযোগাযোগ বাড়ছে। করোনার পর থেকে সব দেশের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে টিকিটের দাম বেড়ে গেছে। ফলে ব্যবসা থেকে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে নৌপথে। পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে নিরাপদ হলো নৌযোগাযোগ খাত। অনেক দেশে কৃত্রিমভাবে নৌযোগাযোগ বাড়ানো হয়। আগে থেকেই কার্গো পরিবহনের জন্য জলপথকে সব থেকে সুলভ পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৭ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা নিবন্ধ অনুযায়ী, একটন মালামাল এক কিলোমিটার পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কপথ এবং রেলপথে যথাক্রমে সাড়ে ৪ টাকা এবং ২.৭৪ টাকা করে খরচ পড়লেও জলপথে এই খরচ মাত্র দশমিক ৯৯ টাকা। জলপথে খরচ এক টাকারও কম। তাছাড়া নৌপথ গুরুত্ব পেলে সড়কপথের ওপর চাপ কমবে।

স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা পর্যন্ত সড়কপথে এক কনটেইনার পণ্য পরিবহনে খরচ পড়ে ২২ হাজার টাকা। নৌ ও রেলপথে এ খরচ যথাক্রমে ১৪ হাজার ৭০০ টাকা ও ১০ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ পণ্য পরিবহনে সড়কপথের চেয়ে রেলপথে খরচ অর্ধেক ও নৌপথে এক-তৃতীয়াংশ কম। তবে স্বাধীনতার পর সড়কপথের দৈর্ঘ্য প্রতিবছর বাড়লেও নৌপথ কমেছে। আমাদের নদীমাতৃক দেশ। অথচ প্রতি বছর নৌ রুট কমে আসছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশের নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ্যের সিকি ভাগের কম অংশে নৌযান চলাচল করতে পারে। শুধু ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখল মুক্ত করে সচল রাখা গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ বাড়বে বলে মনে করা হয়।

নৌপথ কমেছে
প্রতিনিয়ত দখল, ভরাট, নদীর গতিপথের পরিবর্তনের কারণে নৌপথ দিন দিন সংকুচিত হয়েছে। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার। পরের তিন দশকে তা কমে হয় ৬ হাজার কিলোমিটার। ২০০৫ সালে এটি আরও কমে যায়। তখন বর্ষায় নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার আর শুষ্ক মৌসুমে ছিল ৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার। নৌপথ দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে এখন মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটারে নৌযান চলাচল করতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে এটি আরও কমে হয়ে যায় ৪ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার। এই হিসাবে, ছয় দশকে (১৯৬০-২০২০ সাল) দেশের নৌপথ অর্ধেক কমে গেছে।

আরও পড়ুনঃ  বঙ্গবন্ধু আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস : ইউনেস্কো

নৌপথ বৃদ্ধির চেষ্টা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশাল পরিসরে ড্রেজিং পরিচালনার ফলে বাংলাদেশের অসংখ্য নদীতে ফিরেছে নাব্যতা। আর এর মধ্য দিয়ে দেশের নদী ব্যবস্থাপনায় যোগ হয়েছে ২৩০০ কিলোমিটার নৌপথ। ২০০৫ সালে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে জলপথের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র তিন হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মোট জলপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৯০০ কিলোমিটার। পরিবহন সুবিধা বৃদ্ধিতে সরকার ২০০৮ সালে হারিয়ে যাওয়া নৌপথ পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করে। গত এক দশকে ৩২টি ড্রেজার কিনে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া, বেসরকারি খাতকেও নিজস্ব যন্ত্রাদি ব্যবহারের মাধ্যমে নদী উদ্ধারে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্যানুসারে, বাণিজ্যিক ব্যবহারে নতুন নদীপথগুলো চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে, ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত একটি নৌপথ ছাড়াও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একাধিক জলপথ আছে। এর আগে, কয়েক বছরের মধ্যে দশ হাজার কিলোমিটার নদীপথের নাব্যতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার।

দেশে ১০ হাজার কিলোমিটার জলপথ বাড়ানোর জন্য বর্তমানে দেশের ৫৩টি নদীতে ড্রেজিং প্রকল্প চলছে। এর মধ্যে ঢাকার চারপাশে চক্রাকার একটি নদীপথ নির্মাণ প্রকল্পও আছে। এছাড়া, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে গৃহীত একটি প্রকল্প অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নৌ-সংযোগ স্থাপন পরিকল্পনাও এখন বাস্তবায়নের পথে। পাশাপাশি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় মাগুরা থেকে খুলনা এবং মাগুরা থেকে বরিশালের জলপথ পুনরুদ্ধার প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। নদীর পানির মানোন্ননেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে ড্রেজিং।

এছাড়া গোমতী নদী( নারায়নগঞ্জ- দাউদকান্দি রুট), শীতলক্ষ্যা (ডেমরা-ঘোড়াশাল-কটিয়াদি), মেঘনা (লাহারহাট-ভেদুরিয়া), সাহেবেরহাট চ্যানেল (সাহেবেরহাট-টুঙ্গিবাড়ি), আড়িয়াল খাঁ এবং সন্ধ্যা নদী (রামচর- মাদারিপুর), কালিগঙ্গা এবং ঘাঘর নদী (চাঁদপুর- হুলারহাট), তুরাগ (সদরঘাট- আশুলিয়া), আড়িয়াল খাঁ (ঢাকা- জাজিরা- মাদারিপুর- পেঁয়াজখালি), কুমার নদী (মাদারিপুর- গোপালগঞ্জ), মধুমতি নদী (বিলরুট), গোমতী, মধুমতি এবং শৈলদাহ নদী (দাউদকান্দি- হরিদাসপুর) ইত্যাদি নদীপথেও পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক ড্রেজিং পরিচালিত হয়।

আরও পড়ুনঃ  অসহযোগ কর্মসূচি: কী চলবে, কী বন্ধ থাকবে

পরিসংখ্যান নেই
সারাদেশে কি পরিমাণ যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করে সংশ্লিষ্ট দফতর তথা নৌপরিবহন অধিদফতর কিংবা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএর) কাছে সে পরিসংখ্যান নেই। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশে কোনো নৌ শুমারি হয়নি। সরকারি দফতর সূত্রে জানা গেছে, নৌপরিবহন অধিদফতরে যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৪ হাজারের সামান্য বেশি। এর মধ্যে প্রতি বছর সার্ভে (ফিটনেস পরীক্ষা) হয় আট হাজারের মতো। বাকিগুলো ফিটনেস ও রুট পারমিট ছাড়াই চলাচল করে। বেসরকারী হিসেবে সারাদেশে চলাচলরত নৌযানের সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি।

বরাদ্দ কম
নৌপথে গুরুত্ব দিলেও সরকারের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সড়ক, রেল, আকাশ ও নৌপরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পায় নৌপথ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে পরিবহন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫১ হাজার ৮০৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সড়ক খাতে ব্যয় হবে মোট বরাদ্দের ৬২ দশমিক ৬৩ শতাংশ, রেলে ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং আকাশপথের জন্য ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর নৌপরিবহন খাত পেয়েছে ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রায় ২১ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার যাত্রী (এক যাত্রী একাধিকবার নৌপথ ব্যবহার করলে সেটিও অন্তর্ভুক্ত হবে) যাতায়াত করেছে। একই অর্থবছরে পণ্য পরিবহন হয়েছে ১৪১ লাখ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩১ কোটি ৪৭ লাখ ৪০ হাজার যাত্রী পারাপার করা হয়েছে এবং ৫৫৯ দশমিক ৪৫ লাখ মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  ২৮ হাজার বস্তা পেঁয়াজ এল মিয়ানমার থেকে

দুর্ঘটনা কম
নৌপথ ঠিক থাকলে নদীর নাব্যতা ঠিক থাকে, যা সার্বিকভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া নৌপথে দুর্ঘটনার হারও তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৬ হাজার ২০১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫১৬টি দুর্ঘটনাই ঘটেছে সড়কে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন। অন্যদিকে একই সময়ে নৌপথে দুর্ঘটনা ২০৩টি, নিহতের সংখ্যা ২১৯। দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি খাদ্য চাহিদা পূরণেও ভূমিকা রাখে নদ-নদী। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে ৩ লাখ ২০ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয়েছে।

নৌ যোগাযোগ বৃদ্ধি
২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নদীপথে কনটেইনার পরিবহন শুরু হয়। বিভিন্ন দেশের সাথেও নৌ যোগাযোগ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশে। তার অংশ হিসেবে জলপথে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে দু’দেশের যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ১০টি জলপথ সচল রয়েছে। বাংলাদেশের সিলেটের জকিগঞ্জ এবং অসমের করিমগঞ্জের মধ্যে আরও একটি জলপথ উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে। গত মার্চে প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নৌ-প্রটোকল চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে নৌপথে খাদ্যপণ্য পরিবহনের উদ্বোধনী করা হয়। ভূটানের সঙ্গেও নৌ যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে। ভুটান চাইলে বাংলাদেশের তিন সমুদ্র বন্দরের যেকোনোটি করতে পারবে। বাংলাদেশকে ভুটান স্বীকৃতি দেয়ার বর্ষপূর্তিতে গতবছর দেশটিকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন