শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিদেশি গণমাধ্যম ও বিশ্ব বরেণ্যদের চোখে বঙ্গবন্ধু

উনিশ শত একাত্তরের মার্কিন সরকার যতো পকিস্তানপন্থী হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রতিহত করতে যতো উদ্যোগই নেক, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞ শুরুর ১০ দিন আগে ১৫ মার্চই ১৯৭১ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জেনে গেছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে ‘মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছেন’।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এ আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট জোসেফ জে সিসকো সেদিন হেনরি কিসিঞ্জারকে লিখেছেন, ঢাকায় আজ দিনের প্রথম ভাগে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন, তার দল আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে (৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি অধিকার করে) পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার নিয়ে নিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইন প্রশাসন, যা এখনও পাকিস্তান সরকার, তার তোয়াক্কা না করেই মুজিব এককভাবে এ কাজটি করেছেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মুজিবের ঘোষণার ৩৫টি নির্দেশনা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে তুলে নেওয়ার ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ। যদি ইয়াহিয়া কিংবা সামরিক বাহিনীর অন্যরা বলপ্রয়োগ করে মুজিবকে প্রতিহত করেন, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠবে সামরিক বাহিনী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের লড়াইয়ের রণক্ষেত্র। যার ফলে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার আত্মপ্রকাশ ঘটবে।

এই লেখাটিতে একাত্তরে স্বল্প পরিচিত বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর কিছু বক্তব্য এবং তাকে নিয়ে প্রকাশিত নিয়ে কিছু মন্তব্য ভাষান্তরিত হলো:

দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড বলে দিয়েছে পাকিস্তান কার্যত দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে, পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে জানা অসম্ভব। রেডিও পাকিস্তানের ভাষ্য অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই মূলত পূর্বাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ইয়াহিয়ার ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে।

আসলে এখন স্পষ্টতই পৃথিবী জেনে গেছে পাকিস্তান টুকরো হয়ে গেছে; অলৌকিক কোনো রাজনৈতিক ঘটনা ছাড়া পাকিস্তানকে আর এক করা সম্ভব নয়। এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটবে, বিশ্বাস করার কারণ নেই। ইতিহাসের জঘন্য রক্তাক্ত অধ্যায়⎯ব্রিটিশরা আয়ারল্যান্ডে যা করেছে, ফরাসিরা আলজেরিয়াতে যা করেছে এবং এ ধরনের আরও অনেক ঘটনার ব্যাপারে অন্ধ থেকে ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীর বল প্রয়োগের মাধ্যমে সংহতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন। এর ফলাফল যদি এতটা ট্র্যাজিক না হত তার আশা হাস্যকর ঠেকত। পাকিস্তানের সংখ্যালঘুর আধিপত্যে গঠিত কৃত্রিম পাকিস্তান সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ওপর আনুগত্য চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন ইয়াহিয় খান⎯যেখানে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জনগণ শেখ মুজিবুর এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তাঁর দাবিকৃত স্বায়ত্তশাসনের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছে।

এক্সপ্রেসেন স্টকহোম ১ এপ্রিল ১৯৭১ লেখে

শেখ মুজিবুর রহমানকে যে বন্দী করা হয়েছে তা প্রমাণ করতে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ একটি আলোকচিত্র অবমুক্ত করেছে। তাঁর বন্দীদশার ছবিটি দেখিয়ে সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনোবল ভেঙে দিতে চায়। প্রশ্ন, ছবিটি আগে ছাড়া হল না কেন? কোন তারিখের ছবি তা-ই বা উল্লেখ করা হয়নি কেন? তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন দেখাচ্ছে না? এটা স্পষ্ট, ইয়াহিয়া খানের শাসন যে কোনো মূল্যে তাঁর (শেখ মুজিব) শহীদ হওয়ার সুযোগ প্রতিহত করতে চাইবে। প্রশ্ন হচ্ছে কারাবন্দী শেখ মুজিবকে দেখার যে অনুভূতি পূর্ব পাকিস্তানে জন্মাবে, তা কি পরিস্থিতি পাল্টে দেবে? তাঁকে নিয়ে কিংবা তাঁকে ছাড়া (বন্দীদশায় রেখে) যে অবস্থায়ই হোক না কেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর পিছু হটার পথ নেই। সত্য গোপন করার জন্য সামরিক সরকারের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা এখন জানি পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে। শরণার্থীরা ব্যাপক গোলাবর্ষণ, বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ এবং গণহত্যার সাক্ষ্য দিয়েছে।

লা ইউনিটা, রোম ১৮ নভেম্বর ১৯৭১-এর সম্পাদকীয় শিরোনাম

পাকিস্তানি জনগণের ট্র্যাজেডির প্রতীক শেখ মুজিব

সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী সামরিক নেতৃত্বের হাতে কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়তি যেন পাকিস্তানি জনগণের ট্র্যাজেডির প্রতীক। পূর্ব পাকিস্তানে জান্তব নির্যাতনের সবচেয়ে বড় বলি তিনি। আতঙ্কিত মানুষের ভারতে পালিয়ে যাওয়া, অবিশ্বাস্য সংখ্যক মানুষের দেশত্যাগ⎯সবকিছুর পরও রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপই হতে হবে আওয়ামী লীগের নেতার মুক্তি।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত চরিত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এটুকু বলাই যথেষ্ট, পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিক ও কৃষকদের অবস্থা গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে করুণ এবং তারা সবচেয়ে পশ্চাৎপদ।

আরও পড়ুনঃ  রপ্তানি বাণিজ্যে ব্রুনাই

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। আর এর জবাবে ইয়াহিয়া খানের কাছে সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে হল আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে অভিযুক্ত করা, নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে দেওয়া, দেশের পূর্বাংশে সামরিক আঘাত হানা এবং শেখ মুজিসবহ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার করা।

সত্য ঘটনা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঐক্য ও অখণ্ডতা রেখেই স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচির ভিত্তিতেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিশ্রুতি ছয় দফা কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত। এ অবস্থায় রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব বড় ধরনের প্রশ্নের সুরাহা স্বায়ত্তশাসন ও ফেডারেল কাঠামোতে এখনো হয়নি, সেসব এড়িয়ে পাকিস্তানে শান্তি ও গণতন্ত্র রক্ষা এবং শক্তিশালী করার কাজটি কেমন করে হবে, তা কে বলবে।

ভারত-সোভিয়েত ২০ বছর মেয়াদি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চুক্তির যৌথ স্মারকে যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়েছে তা যথার্থ, প্রয়োজনীয় এবং জরুরি। আর যথাসময়ে তা করতে হলে যেসব রাষ্ট্র ও ব্যক্তি শান্তি ভালোবাসে এবং শান্তি চায়, তাদের অপরিহার্য করণীয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতা ফ্যাসিবাদবিরোধী বীর শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সোচ্চার হওয়া এবং মুক্তি আদায় করা।

জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার গোপন বিচার নিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, নভেম্বরে পূর্ব বাংলায় হারিকেনের ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তী কলেরা মহামারির চেয়ে ভয়াবহ হবে এই বিচারের পরিণতি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা উ থান্টের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। আওয়ামী লীগের জন্য ৯৮ ভাগ জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে তারা এই মন্তব্য করেন।… ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন কোথায় মুজিবুর রহমানের বিচার হচ্ছে তা প্রকাশ করতেও অস্বীকার করছে। তাদের সরবরাহকৃত তথ্যে বলা হয়েছে ‘পাকিস্তানের কোথাও’ তার বিচার হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙালিরা কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবে তা যেখানে উদ্বেগের বিষয়, যেখানে তারা পশ্চিমাপন্থী, কিন্তু তারা রেড চীনের প্রতিবেশী, মুজিবুর রহমান যেখানে মধ্যস্থতার চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বেশি ঝুঁকে আছে–তিনি ভোটারের মতামত ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর চাওয়ার তফাতটা ভালো করে জানেন তার গোপন বিচারের পরিণতি ভালো হওয়ার নয়।

ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল পাকিস্তান সরকারকে জানায়

গণতন্ত্রের যে কোনো চর্চায় শেখ মুজিবুর রহমানের আজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকার কথা, ইয়াহিয়া খানের আমলাতান্ত্রিক-সামরিক-সামন্ততান্ত্রিক গোষ্ঠী তাকে ক্ষমতা অর্পণ করতে এবং জনগণের প্রকাশ্য রায় মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। কাজেই জাতীয় আচরণ ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ ব্যতয় ঘটিয়ে সঙ্গোপনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বসানো হয়েছে–উদ্দেশ্য, ক্ষমতালোভী ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা, যারা বাংলাদেশের জনগণের ওপর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং এর মধ্যে শতসহস্র মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

কেবল শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে তার ও তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সমাধান বের করা সম্ভব। কারণ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেন। গোপনে তার বিচার করে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার উপযোগি অভিযোগ দায়ের করা বরং অকারণে ধ্বংসযজ্ঞকেই ডেকে আনা হবে–এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।

মানব আচরণের সব বিধিমালা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং বিশ্ব জনমত সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের নির্বাচিত নেতার বিচারের আয়োজন করেছে। গোপনে বিচার হচ্ছে, কেউ জানে না সামরিক শাসকরা কী ঘটাতে যাচ্ছে। ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’র জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের কথিত বিচার হচ্ছে। আসলে এ ধরনের শব্দগুচ্ছ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে নেওয়া। ঔপনিবেশিক রাজত্বের দিনগুলোতে শত শত ভারতীয় দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযোদ্ধার বিচার হয়েছে ‘রাজা-সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’র জন্য তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে বিচার কখনো গোপনে হয়নি।

কাঠমান্ডু নবীন খবর-এর একটি মূল্যায়ন

সাম্প্রতিক যুদ্ধে পাকিস্তানকে তার অর্ধেকের বেশি অংশ হারাতে হয়েছে। এর কারণগুলো বিবেচনা করা দরকার। কিন্তু তা না করে নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ভুট্টো সাহেব তার দেশের নামে বিবৃতি জারি করছেন, যে দেশ আমাদের কেবল হতাশাই বৃদ্ধি করেছে। সবাই জানেন পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার দায় ইয়াহিয়া খানের চেয়ে ভুট্টোর কম নয়। সাধারণ নির্বাচনের পর ভুট্টো যদি ইয়াহিয়া খানকে কুপরামর্শগুলো না দিতেন, পূর্ব পাকিস্তান তাহলে আজ আর আলাদা দেশে রূপান্তরিত হত না। যেভাবেই হোক পূর্ব পাকিস্তানের সব নাগিরকের প্রত্যাশার মুখে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।

আরও পড়ুনঃ  জরিমানা ছাড়াই বাড়ছে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের সময়!

পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর এ সত্যকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ভুট্টো সাহেবের উচিত সত্য অনুধাবন করা। আমরা তাকে সেই পরামর্শই দেই। গতকাল তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন তা স্ববিরোধী ও হতাশাব্যঞ্জক। তিনি দাবি করেন, তিনি পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা। কিন্তু তাকে স্বীকার করতেই হবে নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান তার চেয়ে আরো বড় নেতা। তিনি যদি নির্বাচনের রায়কে গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে মেনে নিতেন তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য কোনো মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজন হত না। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লাগত না এবং এমনভাবে পাকিস্তানকে পরাজিতও হতে হত না।

পাকিস্তানি সরকারও তাদের শ্বেতপত্রে উল্লেখ করেছে: টাইম পত্রিকার সংবাদদাতা ড্যান কোগিনকে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। ফয়সালার আর কোনো আশা নেই। এর দুদিন আগে পূর্ব পাকিস্তানি নেতা পশ্চিম পাকিস্তানিদের উদ্দেশ করে বলেছেন, আমি তাদের ভেঙে ফেলব এবং হাঁটুর উপর দাঁড় করিয়ে ছাড়ব। তখনই মনে হচ্ছিল এই নেতা সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে।

পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে তিনি অসীম আনন্দ লাভের কথা বলেন, এন্থনি লুইস লিখেছেন সে কথা

‘গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ, আমার দেশবাসীর সাথে স্বাধীনতার অসীম আনন্দ ভোগ করার জন্য আজ আমি মুক্ত’– এই বলে তিনি লন্ডনের সংবাদ সম্মেলন শুরু করলেন।
আমরা এক মহাকাব্যিক স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের সংগ্রামের চূড়ান্ত অর্জন স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ যে দেশের জনগণ আমাকে তাদের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে।

এক সময় যা পাকিস্তানের পূর্বাংশ ছিল তাই স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে ধরে রাখতে তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী। তিনি বলেছেন, ভুট্টো তাকে অনুরোধ করেছেন পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত থাকার একটি সম্ভাব্য যোগসূত্র যেন বিবেচনা করেন। জবাবে তিনি বলেছেন, দেশে না ফেরা পর্যন্ত তার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়।

শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তন

ব্রিটেনের কাছ থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা প্রত্যাবর্তন এবং উচ্ছসিত স্বাগতমই সবচেয়ে আবেগময় ঘটনা। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সঙ্কটসহ ঘোষিত স্বাধীনতা যে সঙ্কট টেনে এনেছে সবগুলোই তাকে মোকাবেলা করতে হবে।

পাকিস্তানের অংশ হবার আগে থেকেই বাংলাদেশের বঞ্চিত হবার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; অর্থনীতিকে সচল করতে যা করণীয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা এখানে তার অতি সামাণ্যই করেছে অথবা আদৌ করেনি। পশ্চিম পাকিস্তান কেবল নিজের উন্নয়নের জন্য তহবিল ব্যবহার করেছে রাষ্ট্রীয় নীতিমালাই এমন ছিল যে কেবল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতেই রক্তপাত ঘটবে। বৈষম্যের এই অসন্তোষই পূর্বাংশে বিদ্রোহের সৃষ্টি করেছে এবং ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ বাধিয়েছে।

স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে স্বাধীনতা ধরে রাখা আর তা নির্ভর করবে মুজিব কেমন করে তার দেশের জনগণকে চালাবেন তার উপর; যে সব বিভাজনের কারণে দেশ খন্ডিত হয়ে নতুন দেশের সৃষ্টি হয়েছে, তা যেন নতুন দেশে সৃষ্টি না হয়; যে প্রশাসন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশের সংহতি ধরে সচেষ্ট হয়।

পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে মুজিব দেখিয়ে দিয়েছেন তার রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থন এবং প্রত্যাবর্তণের পর দেশে তাকে যে স্বাগতম জানানো হয়েছে তা প্রমাণ করে তিনি সেই সমর্থন ধরেও রেখেছেন। এখনকার আনন্দ উচ্ছাসের মুহুর্ত যখন শেষ হয়ে আসবে এবং বিধ্বস্ত দেশকে সচল করতে, দেশকে যখন পুননির্মাণ করতে হবে তখনই শুরু হবে সত্যিকারের পরীক্ষা।

নতুন স্বঘোষিত রাষ্ট্রের স্বতন্ত্রভাবে টিকে থাকতে বৈদেশিক সহায়তা হচ্ছে অন্যতম চাবিকাঠি। কিন্তু সে জন্য আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি সামনে এসে যায়। শেখ মুজিব এই বিষয়টি এর মধ্যেই ব্রিটেনের কাছে উত্থাপন করেছেন অষ্ট্রেলিয়াও নিশ্চয় এ ব্যাপারে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নেবে।

আরও পড়ুনঃ  কলাপাড়ায় নিহত ১, আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ

স্পষ্টতই মুজিব ও তার সরকারকে দেখাতে হবে তারাই দেশের নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন তারা পেয়ে আসছেন। যখন এ বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হবে অষ্ট্রেলিয়া সামনে এগিয়ে যেতে পারবে এবং বৃহৎ শক্তিগুলো কি করছে সে জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে।
(সম্পাদকীয়, মার্কারি ১১ জানুয়ারি ১৯৭২)

সিডনি শনবার্গের নেওয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের একাংশ

পাইপমুখে শেখ সাহেব-এই হচ্ছে সিগনেচার ফটোগ্রাফ। যারা তাঁকে এ অবস্থায় দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন, পাইপ ছাড়া তাঁর এ ধরণের ফটোগ্রাফ অসম্পূর্ণই মনে হবার কথা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা যখন তাঁকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, গাড়িতে উঠার সময় বঙ্গবন্ধুর মনে হলো পাইপ আর তামাক সাথে নেন নি।

তিনি তার ক্রন্দনরত স্ত্রী ও সন্তানদের বিদায়ী চুম্বন করলেন, তারা যে কথাটি খুব ভালো করেই জানতেন, তিনি সে কথাটিই বললেন হয়তো তিনি আর ফিরবেন না। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে খোঁচা দিয়ে সিঁড়ি পথে নামাচ্ছে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে পেছন থেকে আঘাতও করেছে। তিনি তাদের জিপ পর্যন্ত পৌঁছালেন, তারপর হঠাৎ তার অভ্যাসজনিত প্রতিক্রিয়া ও স্পর্ধা থেকে বলে উঠলেন, ‘আমি আমার পাইপ আর তামাকের কথা ভুলে গেছি। আমাকে অবশ্যই আমার পাইপ আর তামাক আনতে হবে।’

সৈন্যরা ধাক্কা খেল, তাদের হতবুদ্ধি অবস্থা, কিন্তু তারা তাকে এসকর্ট করে বাসা পর্যন্ত নিয়ে এলো, সেখানে তার স্ত্রী পাইপ আর তামাকের থলে তার হাতে তুলে দিলেন।

তারপর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে সাড়ে নয় মাস কারারুদ্ধ রাখতে তাকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেল। তার বর্ণনার এটি একটি অংশ, শেখ মুজিবুর রহমান তার গ্রেপ্তার কারাবাস ও মৃত্যু থেকে কোনোভাবে বেঁচে আসার এবং সপ্তাহ আগে তার মুক্তির কাহিনী এই প্রথম বর্ণনা করলেন।

২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় তিনি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি গোপন সদর দপ্তরে ফোন করে তার নিজস্ব লোককে একটি শেষ বার্তার ডিকটেশন দিলেন, যা পরে রেকর্ড করা হয় এবং গোপনীয় ট্রান্সমিটারে সম্প্রচার করা হয়। সম্প্রচারের সার কথা হলো, সেনা আক্রমণ তাদের প্রতিহত করতে হবে, তাদের নেতার যাই ঘটুক, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার কথাও বলেছেন।

শেখ মুজিব জানালেন, এই বার্তা পাঠানোর পর প্যারা মিলিটারি ইউনিট পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের লোকদের এবং তার প্রহরায় থাকা তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের লোকদের নির্দেশ দিলেন। রাত ১১টায় সারা শহরে পশ্চিম পাকিস্তানি আক্রমণ শুরু হলো এবং খুব দ্রুত আক্রমণ তুঙ্গে উঠে গেল। মধ্যরাত থেকে রাত ১টার মধ্যে সেনাবাহিনী শেখ মুজিবের বাড়িতে গুলি করতে শুরু করল। তিনি তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ওপরতলায় ড্রেসিং রুমে ঠেলে দিলেন এবং যখন মাথার ওপর দিয়ে বুলেট ছোটা শুরু করল, তারা মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে রইলেন। সৈন্যরা তখন দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকল, যে প্রহরী তাদের ভেতরে যেতে বাধা দিচ্ছিল, তাকে গুলি করে হত্যা করে ঝড়োগতিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়।

শেখ মুজিব ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে তাদের মোকাবেলা করে বললেন: ‘গুলি বন্ধ করো! গুলি বন্ধ করো! তোমরা গুলি করছ কেন? যদি গুলি করতে হয় আমাকে করো; এই তো, আমি এখানে, আমার মানুষদের, আমার সন্তানদের কেন গুলি করছ?’

আরেক পশলা গুলির পর একজন মেজর তার লোকদের থামান এবং আর গুলি না করার নির্দেশ দেন।

মেজর শেখ মুজিবকে জানান, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে; তাঁর অনুরোধে মেজর তাকে বিদায়ী কথা বলার জন্য কয়েক মুহূর্তের সুযোগ দেয়। তিনি পরিবারের সব সদস্যকে বিদায়চুম্বন দেন এবং তাদের বলেন, ‘তারা আমাকে মেরে ফেলবে, তোমাদের সঙ্গে আমার আর দেখা নাও হতে পারে। কিন্তু আমার মানুষেরা কোনো না কোনো দিন স্বাধীন হবে আর আমার আত্মা তা দেখে সন্তুষ্ট হবে।’

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন