স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া শিশুদের তুলনায় সিজার অপারেশনে জন্ম নেওয়া শিশুদের শরীরে হামের টিকা সম্পূর্ণ অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ২ দশমিক ৬ গুণ বেশি। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ ও চীনের ফুদান ইউনিভার্সিটির যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণাপত্রটি নেচার জার্নালের সোমবার (১৩ মে) মাইক্রোবায়োলজি (অণুজীববিজ্ঞান) বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে।
এ গবেষণায় বলা হয়, টিকা অকার্যকর হওয়ার মানে হলো—প্রথম ডোজের টিকা গ্রহণের পরও শিশুর রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা হামের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করতে না পারা।
ফলে শিশুরা এই রোগের ক্ষেত্রে সংবেদনশীল থাকে। তবে দ্বিতীয় ডোজের টিকা সিজার অপারেশনে জন্ম নেওয়া শিশুদের শরীরে হামের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলে। বলা হয়ে থাকে, হাম একটি অত্যন্ত সংক্রামক ব্যাধি। টিকার কার্যকারিতার হার সামান্য কম হলেও এর প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে।
এ ক্ষেত্রে টিকা অকার্যকর হওয়ার একটি সম্ভাব্য কারণ হলো—শিশুর অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের (উপকারী অণুজীব) সঠিক বিকাশ না হওয়া। অসংখ্য ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং এককোষী অণুজীব নিয়ে অন্ত্রের ‘মাইক্রোবায়োম’ তৈরি হয়। অন্ত্রে প্রাকৃতিকভাবেই এর বিকাশ ঘটে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিকভাবে প্রসবের সময় প্রসূতির কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের উপকারী অণুজীব নবজাতকের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। এসব অণুজীব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
স্বাভাবিকভাবে নাকি সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে শিশুর জন্ম হয়েছে— সেটি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রাখে বলে জানিয়েছেন গবেষণাপত্রটির কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও যুগ্ম প্রধান লেখক হেনরিক সালজে। তিনি বলেন, অনেক শিশুর হামের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয় না, যা শিশুর নিজের জন্য ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য বিপজ্জনক। কারণ সিজারে জন্ম নেওয়া শিশুর শরীরে প্রথম ডোজের টিকার সেভাবে কোনো কার্যকারিতা থাকে না। তাই সিজারে জন্ম হওয়া শিশুদের দ্বিতীয় ডোজের হামের টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় প্রথম ডোজের টিকা দেওয়ার পরও শিশুর হাম হলে, অভিভাবকেরা আর দ্বিতীয় ডোজ দিতে আগ্রহী হয় না।
উল্লেখ্য, হাম নিয়ন্ত্রণে জনসংখ্যার অন্তত ৯৫ শতাংশকে সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার ‘রুটিন চাইল্ডহুড ইমিউনাইজেশন’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে হাম, মাম্পস এবং রুবেলা (এমএমআর) টিকা সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও দেশটিতে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়ার হার অনেক কম।
বর্তমান বিশ্বেই সিজার অপারেশনে সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। যুক্তরাজ্যে এখন এক-তৃতীয়াংশ শিশুরই জন্ম হয় সিজার অপারেশনের মাধ্যমে। ব্রাজিল ও তুরস্কে অর্ধেকেরও বেশি শিশুর জন্ম হয় এভাবে। গবেষক সালজে বলেন, স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া শিশুদের মতো সিজারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুরা একইভাবে মায়ের মাইক্রোবায়োমের সংস্পর্শে আসে না। ফলে তাদের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম বিকাশে বেশি সময় লাগে। এ কারণে হামসহ বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এসব শিশুকে অবশ্যই পূর্ণ ডোজ টিকা দিতে হবে। বিষয়টি নিয়ে পর্যবেক্ষণের জন্য চীনের হুনান প্রদেশের ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি শিশুর পূর্ববর্তী গবেষণার ডেটা ব্যবহার করেন গবেষকেরা। জন্ম থেকে ১২ বছর পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে এসব শিশুর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মাধ্যমে জীবনের প্রথম কয়েক বছরে তাদের রক্তে হামের অ্যান্টিবডির মাত্রা কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে তা দেখা যায়। এ ছাড়া টিকা দেওয়া পরও অ্যান্টিবডির মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
উক্ত গবেষণায় দেখা যায়, হামের টিকা নেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া ৫ শতাংশ শিশুর মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি। বিপরীতে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া ১২ শতাংশ শিশুর মধ্যে প্রথম ডোজের টিকার কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থাৎ সিজারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদের প্রথম টিকার বিপরীতে তুলনামূলক কম প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।
এছাড়া এতে জানানো হয়, দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও হামের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য হামের টিকার দুটি ডোজই দিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২২ সালে বিশ্বের মাত্র ৮৩ শতাংশ শিশু প্রথম জন্মদিনের মধ্যে হামের টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছে, এ হার ২০০৮ সালের পর সর্বনিম্ন।
প্রসঙ্গত, হাম বিশ্বের অন্যতম ছোঁয়াচে রোগ, যা কাশি ও হাঁচির মাধ্যমে ছড়ায়। এটি ঠান্ডা-জ্বরের মতো উপসর্গ ও গায়ে ফুসকুড়ি দিয়ে শুরু হয়। এই রোগে অন্ধত্ব, খিঁচুনি ও শারীরিক গুরুতর জটিলতা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। ১৯৬৩ সালে হামের টিকা আবিষ্কার হয়। এর আগে কয়েক বছর পরপর হাম মহামারির আকার ধারণ করত। হামের প্রাদুর্ভাবে প্রতিবছর প্রায় ২৬ লাখ মানুষের প্রাণহানি হতো।