পুতুল, লেইস ফিতা, চুড়ি,চেইন, আংটি, ক্লিপ, ব্যাগ, সানগ্লাস, মেলামাইন সামগ্রী, কেরকেরি গাড়ি, বাঁশি, বল, বন্দুক, গাড়ি, মাটি ও কাঁঠের তৈরীসহ নানা প্রকারের সামগ্রি নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে আছেন অনেক নারী পুরুষ। প্রতিটি দোকানে রয়েছে ৪-৫ জন করে লোক। মালামাল ক্রয় বিক্রয় ও তৈরীতে সবাই যেন ব্যস্ত সময় পার করছেন। এমন দৃশ্য চোখে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের খড়মপুর এলাকায়। গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে হয়রত সৈয়দ আহমদ গেছু দারাজ প্রকাশ্যে কেল্লা শহীদ (রহ:) মাজারে ওরশ মোবারক। তবে এই ওরশকে কেন্দ্র করে মাস ব্যাপী চলছে মেলা। মেলা ঘিরে স্বপ্ন হওয়ায় জীবিকার তাগিদে অন্ত:ত শতাধিক পরিবার ওইসব ক্ষুদ্র ব্যবসা করে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন।
মেলায় একাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানায়, সুর্দীঘ বছর ধরে তারা মেলা কেন্দ্রিক এই ব্যবসা করছেন। বছরের বেশীভাগ সময় তাদের বাহিরে থাকতে হয়। দেশের যেখানেই মেলা হচ্ছে সেখানে ওইসব মালামাল নিয়ে তারা হাজির হচ্ছেন। এতেই চলছে তাদের জীবিকা। তবে অন্যান্য এলাকার পাশাপাশি এ উপজেলার অন্ত:ত ২০ টি পরিবার এ পেশায় যুক্ত হয়ে আছে বলে একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তারা দীর্ঘ বছর ধরে মেলা কেন্দ্রিক এ ব্যবসা করছেন। তবে দিন দিন মালামাল, যাতায়ত খরচ, দোকান ভাড়াসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে একাধিক ব্যবসায়ীরা জানায়।
এ পেশার সাথে জড়িতরা বলেন তাদের বাপ দাদারা এ পেশায় যুক্ত থাকায় তারা এখন এ ব্যবসা করছেন।
অন্য কাজ জানা না থাকায় তাদের দীর্ঘ বছর ধরে এ ব্যবসা ধরে রেখেছেন। আর তাদের পরিবারগুলো অনেকটাই এই ব্যবসার উপর নির্ভরশীল হওয়ায় এতেই চলছে তাদের জীবিকা।
কথায় আছে আমাদের দেশ পীর আওলিয়ার দেশ। এদেশে অসংখ্য পীর আওলিয়ার মাজার রয়েছে। দেশে দীর্ঘ বছর ধরেই একটি রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে মাজার কেন্দ্রীক বার্ষিক ওরশ, বাংলা ও ইংরেজি সনের বিশেষ মাস উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। যেখানে মেলা হয় সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় সূত্রে তথ্য মতে আখাউড়া পৌর শহরের খড়মপুর শাহ পীর কল্লা শহীদ (রহ:) মাজার, দেবগ্রাম শাহ সুলতান মাজার, তারাগন শেরআলী শাহ (রহ:) দরবার শরীফ, ধরখারের ছতুরা শরীফ, কসবা উপজেলার আড়াইবাড়ি দরবার শরীফ, ব্রাক্ষবাড়িয়ার চাপুর লতিফিয়া দরবার শরীফ, ভাদুঘরের বৈশাখী মেলা, বিজয়নগরের বৈশাখী মেলা, দৌলতবাড়ি দরবার শরীফ, নবীনগরের হযরত গনি শাহ (রহ:) মাজার শরীফ, কুমিল্লার বেলতলির সুলমান শাহ(রহ:) মাজার, শাহজীবাজারের শাহ ফতেগাজী (রাহ) মাজারসহ অস্যখ্য স্থানে বার্ষিক মেলা হয়ে থাকে। ওইসব মেলায় রকমারি মালামাল নিয়ে দোকান বসান ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা। তবে স্ব স্ব স্থানের লোকজনরাই ওইসব আয়োজনের নিয়ন্ত্রন করে থাকে।
ব্যবসায়ীরা জানায়, মেলায় দোকান তৈরী ও মালামাল সাজাতে অন্তত ৫-৬ ঘন্টা সময় লেগে যায়। প্রতিটি দোকানে নিচে ৪-৫ জন লোক থাকতে হয়। সাধারণত মেলা ১ থেকে ৭ দিন পযর্ন্ত থাকে। আবার কোন কোন জায়গাতে মাসের উপর চলে। তবে মেলায় প্রতিদিনই ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। ক্রয় বিক্রয় নাওয়া খাওয়া ঘুম সব কিছু দোকানেই তাদের করতে হয়। পৌর শহরের খড়মপুর এলাকায় মেলায় কথা হয় কুমিল্লার হোমনার ফরিদ মিয়া, নাঙ্গলকোটের ইয়াছিন মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের নুরজাহান বেগম, কিরন মিয়া, নবীনগরের আলফু মিয়া খড়মপুরের মর্জিনা আক্তার ও পারুল বেগমের সাথে। তারা জানায়, এটা তাদের বাপ দাদারা করে আসছে। তাদের হাত ধরে এ পেশায় আসেন। দেশের যেখানেই মেলা হচ্ছে সেখানেই বাঁশি, বল, বন্দুক, গাড়ি, পুতুল, নানা রকম খেলনা জিনিস, লিস ফিতা, চুড়ি, চেইন, আংটি ভ্যান রকমারি সাজনিসহ বিভিন্ন জিনিস নিয়ে ছুটে যান। মেলায় কষ্ট হলেও ভালো বেচা কিনা হয়।
মো: বাহাদুর আলম বলেন, স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান মিলে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কাঁঠের নানা খেলনাসহ নানা প্রকারের জিনিস তৈরী করে মেলায় ব্যবসা করছেন। মালামাল তৈরী বিক্রি এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়ত কষ্ট হলেও মেলায় পরিবেশ ভাল থাকলে দৈনিক ভালো টাকা বিক্রি হয়। মেলায় যাতায়ত, খাওয়াসহ যবতীয় খরচ বাদে প্রতিদিন ৩-৪ হাজার টাকা আয় হয়।
তিনি আরও বলেন বর্তমানে তার দোকানে পুঁজি রয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকার উপর। বছরের বেশীভাগ সময় তাদের বাহিরে থাকতে হচ্ছে। তবে যে সময় মেলা থাকে না তখন এলাকায় ফেরি ও হাট বাজারে বসে ওইসব মালামাল বিক্রি করা হয়। তিনি বলেন প্রতি বছরের ন্যায় এবার খড়মপুরে আসা হয়েছে। এখানে ১মাসের উপর মেলা থাকবে। এ বছর এখানে শুরু থেকেই ভালো মালামাল বিক্রি হচ্ছে।
মো. হাবিব মিয়া বলেন, তার বাড়ি কুমিল্লার হোমনা এলাকায়। আজ থেকে ২০ বছর পূর্বে মাত্র ৫ হাজার টাকা পুঁজিতে পুতুল, লেইস ফিতা, চুড়ি,চেইন, আংটি, ক্লিপ, ব্যাগ, সানগøাসসহ নানা প্রকারের সামগ্রি নিয়ে মেলায় তার ব্যবসা শুরু হয়। বর্তমানে তার ৩ লাখ টাকার উপর মালামাল রয়েছে। মেলাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গাতে যাওয়া হয়। এ কাজে স্ত্রী ও ছেলে সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করছেন। তিনি আরো বলেন মেলায় লোকসমাগম ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে কেনা বেচা। সব কিছু ভাল থাকলে দৈনিক ৩০-৩৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়। তার ২ ছেলে ১ মেয়ের মধ্যে বর্তমানে ১ মেয়ে এসএসসি পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আর ছোট ছেলে ৮ম শ্রেণিতে পড়ছে। বড় ছেলে তার সাথে রয়েছে। মেলা না থাকলে ফেরি করে মালমাল বিক্রি করছেন। মাস শেষে যাবতীয় খরচ বাদে ৩০ হাজার টাকার উপর আয় হয় বলে জানায়।
পাথরের আংটি বিক্রেতা জেলর নবীনগরের তাহের আলী জানায়, তার পিতা অসুস্থ হওয়ায় ও পুঁজির অভাবে অন্য ব্যবসা করতে পারিনি। কোন উপায় না পেয়ে প্রায় ৭ বছর ধরে তিনি মেলায় মেলায় পাথরের আংটি বিক্রি করছেন। তাছাড়া মেলা না থাকলে বিভিন্ন হাট বাজারে পাথরের আংটি বিক্রি করা হয়। তিনি বলেন মেলায় আংটির ভালো চাহিদা রয়েছে। বিক্রি ভালো হয়।
খড়মপুর মাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: রফিকুল ইসলাম খাদেম মিন্টু বলেন, গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে হয়রত সৈয়দ আহমদ গেছু দারাজ প্রকাশ্যে কেল্লা শহীদ (রহ:) মাজারের ওরশ মোবারক। তবে এই ওরশকে কেন্দ্র করে এখানে মাস ব্যাপী চলছে মেলা। মেলায় রকমারি পণ্য উঠেছে। এ মেলায় স্থানীয়দের পাশাপাশি অন্যান্য জায়গা থেকে অসংখ্য লোকজন আসছেন।
আনন্দবাজার/শহক