শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে “মালঞ্চ”

হারিয়ে যাচ্ছে মালঞ্চ

নদীবিধৌত বাংলাদেশের মধ্যবর্তী ফরিদপুর জেলা গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান নদী পদ্মার অববাহিকায়। আর এই জেলা শহরের কোল জুড়ে বয়ে চলা কুমার নদের পার্শ্ববর্তী সালথা উপজেলা সদর বাজার অতিক্রমকালে সৃষ্টি হয়েছে এর একটি শাখা নদী। যার নাম মালঞ্চ। প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রবাহিত মালঞ্চ নদীর অস্তিত্ব জড়িয়ে রয়েছে কয়েকশ বছরের ইতিহাস। আর এ নদীর নামকরণের সাথেও রয়েছে এক শোকগাথা।

এক সময় মাত্র ৩০ থেকে ৪০ বছর আগেও মালঞ্চ নদী ছিল নানান জাতের দেশীয় মাছের সম্ভারে পরিপূর্ণ। স্থানীয়রা সেই মাছ শুটকি দিয়েও সারাবছরের খাদ্য সংস্থানের জন্য রেখে দিতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে অনেককিছুর সাথে মালঞ্চ নদীও তার আগের রুপলাবন্য হারিয়েছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, নদীর এমন সুন্দর একটি নামই হারাতে চলেছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানেই না, ফরিদপুরেও মালঞ্চ নামে একটি নয়নাভিরাম নদী রয়েছে। কিংবা নদীর পাড়ে বসত করেও এই প্রজন্মের অনেকে জানেনা, এই নদীর নাম মালঞ্চ।

জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবনের মধ্যে মালঞ্চ নামে একটি নদী রয়েছে। এই নামে নদী রয়েছে রাজশাহীতেও। সেসব নদীর মতো সুদীর্ঘ না হলেও ফরিদপুরের মালঞ্চ নদী অনেক পুরনো। সালথার গট্টি বাজারে কুমার নদ থেকে উৎপত্তি লাভ করে সিংহপ্রতাপ, গৌড়দিয়া, সলিয়া, সেনহাটি, খাগৈড়, গোয়ালপাড়া, গোবিন্দপুর, দুর্গাপুর এই আটটি গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে গেছে মালঞ্চ নদী।বিভিন্ন জনপদ ও গ্রাম ছাপিয়ে নদীটি ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আবারও কুমার নদের সাথে মিশেছে। এজন্য অনেকে এটিকে কুমার নদের অংশ মনে করে। কেউ ভাবে খাল!

আরও পড়ুনঃ  পুরোনা ফ্ল্যাটে প্রবাসীদের বিনিয়োগ

শুকনো মৌসুমে খড়ায় পানি শুকিয়ে জেগে উঠে মালঞ্চ নদীর উদােম শরীর। নদীটি সম্প্রতি খনন করা হয়েছে। এখন শুকনো মৌসুমে হাঁটু পানি থাকে কোথাও। বর্ষায় পানিতে ভরে উঠে নদীর বুক। ফরিদপুরের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট জাগ দেয়া হয় বর্ষা মৌসুমে। পাটের পঁচা হাজামজা পানি নিয়েই বয়ে চলে সে। গ্রামের সহজসরল প্রকৃতির মতোই স্নিগ্ধতা মেশানো তার ছুটে চলা। সুন্দর স্নিগ্ধতা জড়ানো এই নদী যেন সকলের অগোচরে হারিয়ে যাচ্ছে। ফরিদপুরের সরকারি-বেসরকারি নথিপত্রে কোথাও নেই মালঞ্চ নদীর অস্তিত্ব।

স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক সুজিত দত্ত ওরফে উত্তম জানান, নবাবী আমলে স্থানীয় একজন জমিদার ছিলেন প্রতাপ সিংহ। তার মেয়ে মালঞ্চ নদীতে নৌকাডুবিতে মারা গেলে তার নাম অনুসারেই এই নদীর নাম হয় “মালঞ্চ”।

শ্রাবণ হাসান নামে স্থানীয় এক সংবাদকর্মী বলেন, এমন একটি সুন্দর নামের নয়নাভিরাম নদী রয়েছে আমাদের সালথায় অথচ তেমনভাবে কখনো জানা হয়ে উঠেনি। নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগই এ নদীর নাম জানেনা।

স্থানীয় সেলিম রানা নামের আরেক যুবক বলেন, নিবীড় প্রকৃতির মাঝে বয়ে চলা মালঞ্চ নদীর অপরূপ দৃশ্য সকলকে আকৃষ্ট করে। নদীটি এখনো হারিয়ে যায়নি। তবে এই নদীর সুন্দর নামটি এখন হারাতে চলেছে।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ৬০ এর দশক থেকে ৮০ দশকেও এই নদীতে দেশীয় জাতের প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত মাছ শুকিয়ে শুটকী করে রাখা হতো। এটি কোন রুপকথা নয় বাস্তব সত্যি কথা। সেই ভরা ঐশ্বর্যের মালঞ্চ নদী আজ শুধু তার নাব্যতাই হারায়নি, নামটিই হারাতে চলেছে।

আরও পড়ুনঃ  মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ ৪৯.১৫ শতাংশ সম্পন্ন

স্খানীয়দের মতে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব থেকে বাঁচতে হলে আরো অনেক নদ-নদীর মতো মালঞ্চ নদীর রুপলাবণ্য ফিরিয়ে আনা সময়ের অপরিহার্য দাবি।

ফরিদপুরের নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বলেন, বর্তমান প্রজন্মের অনেকে এই নদীর নামই হয়তো জানেনা। তবে নদীটি রক্ষা যেমন জরুরি, তেমনি মালঞ্চ নদীর নামটিও সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ থাকা দরকার।

এব্যাপারে সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন শাহিন বলেন, এ নদীর বিষয়টি আমার জানা ছিলনা। সাংবাদিকদের মাধ্যমেই আমি জানাতে পেলাম নদীটির কথা। এব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে দেখব। আর যদি সরকারি নথিপত্রে এই নদীর নাম ও তথ্য না থাকে তাহলে তা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমাদের পক্ষ থেকে নেওয়া হবে।

এব্যাপারে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, নদী নিয়ে আমাদের নতুন করে আপডেট তালিকা করা হচ্ছে। যদি সেটা অন্তর্ভুক্ত না থাকে তবে নদীর শ্রেণির মধ্যে পড়লে সেটা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে অন্যন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন