রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিতে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অস্থির ডলারের বাজার সুস্থির করতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) ৭.৬৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর আগে ছয় মাসে রিজার্ভ থেকে এতো ডলার কখনই বিক্রি হয়নি। গত মঙ্গলবারও রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ৮ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর ফলে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ার পরও দু-একদিনের মধ্যেই রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
গেল অর্থবছরের পুরো সময় ধরে চলে ডলার বিক্রি। রিজার্ভ থেকে ডলার বাজারে না ছাড়লে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আরও বেড়ে যাবে-এ বিবেচনায় ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রির মধ্য দিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। অথচ গত অর্থবছরের পুরো সময়ে রিজার্ভ থেকে ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগে অর্থবছরে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজার থেকে উল্টো প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
রিজার্ভের এই চাপের মধ্যেই চলতি সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১.১২ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। ফলে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক আরও কমে ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ যে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে বাজার থেকে ডলার কেনার অবদান ছিল বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। আবার এখন যে রিজার্ভ কমছে, তাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদ।
করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে আমদানি বাড়তে শুরু করে; লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে অর্থনীতির এই সূচক। তাতে বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে দাম। সেই চাহিদা মেটাতে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আগে সব ব্যাংকের কাছে প্রয়োজনীয় ডলার বিক্রি করলেও গত তিন মাস ধরে শুধু সরকারি কেনাকাটা ও জ্বালানি তেল, স্যারসহ অন্যান্য অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য এলসি বা ঋণপত্র খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি খরচ মেটাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ক্যালেন্ডার বছরের হিসাবে বিদায়ী বছরে রিাজার্ভ থেকে মোট ১২.৬১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এতে অভ্যন্তরীণ তারল্যের ওপর চাপ বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে এমনিতেই সঞ্চয় প্রবণতা কমছে। ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্য জানাজানির পর কোনো কোনো ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়েছে। টাকার সংকট মেটাতে আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। যদিও ঋণের সুদে ৯ শতাংশের সীমা রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রিজার্ভ থেকে ৭.৪৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি জানুয়ারি মাসের তিন দিনে (১ থেকে ৩ জানুয়ারি) আরও ১৮ কোটি ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭.৬৫ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫.১৪ বিলিয়ন ডলার।
অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির ফলে রিজার্ভ কমছেই। গত মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ছিল ৩৩.৭৪ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ৩ জানুয়ারি যা ছিল প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার ছিল। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল গত বছরের আগস্টে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ এবং ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, আকুর ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করা হবে। আগামী সপ্তাহে তা রিজার্ভ থেকে সমন্বয় করা হবে। তখন রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ মেনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রিজার্ভের হিসাব করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। মহাসংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কা অবশ্য মাস দেড়েক আগে শ্রীলঙ্কা আকুর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
এর আগে গত নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের আকুর বিল পরিশোধ করে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ হিসাবে গত অক্টোবর মাসে মোট ৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। এ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি বিল মেটানো সম্ভব।
এদিকে, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দর আরও ১ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মঙ্গলবার থেকে ১০০ টাকা দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এতদিন প্রতি ডলারের জন্য ৯৯ টাকা নেয়া হতো। গত ৫ ডিসেম্বর থেকে প্রতি ডলার ৯৯ টাকায় বিক্রি করা শুরু করা হচ্ছিল। মঙ্গলবার থেকে তা ১ টাকা বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে যে ৮ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে তা ১০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়েছে।
তবে সব ব্যাংক এই দরে ডলার পাচ্ছে না। সরকারের প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য শুধুমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্য ব্যাংকগুলোকে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। গত মঙ্গলবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৪ টাকা ৩৫ পয়সা, সর্বনিম্ন ১০৩ টাকা ৪৪ পয়সা। সব ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সঞ্চিত রিজার্ভ আরও কমে যাবে। সেজন্য সরকারের প্রয়োজনেই শুধু রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড়া হচ্ছে।
আনন্দবাজার/শহক