শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বরিশালে ভয়াবহ বায়ুদূষণ

বরিশালে ভয়াবহ বায়ুদূষণ
  • দূষণে ঢাকার পরই দ্বিতীয় অবস্থানে এ জেলা

দেশের বায়ুদূষণ প্রবণ এলাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেখানের মানুষ বেশি মাত্রায় বিষণ্নতায় ভুগছেন। ২০১৯ সালে দেশে বায়ুদূষণে সর্বোচ্চ ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষণ্নতায় ভুগছেন। দেশে বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এরপরই অবস্থান বরিশাল বিভাগের।

গত রবিবার বিশ্বব্যাংকের প্রকাশ করা ‘ব্রিদিং হেভি: বায়ুদূষণের নতুন তথ্য-প্রমাণ এবং স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘দেশের বৃহত্তম সিগারেট কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর বাংলাদেশের পরিচালকদের মধ্যে সাতজন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি বিষণ্নতায় ভুগছেন ৬৫ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সীরা। সামগ্রিকভাবে দেশের বায়ুদূষণযুক্ত এলাকার ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ নারী বিষণ্নতায় ভুগছেন। আর ১১ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যায়।

‘তামাক বন্ধের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে’ অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যানবাহনে যে জ্বালানি তেল ব্যবহার করি, তাতে দূষণ বেশি হয়। দূষণ কমাতে উন্নত মানের তেল আমদানি করতে হবে।’ সিগারেটের ধোঁয়াকে বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হিসেবে উল্লেখ করেন সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘তামাকের কারণে সারা বিশ্বে ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। তামাকের ক্ষেত্রে সরকার রাজস্ব বাড়ানোকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। জনস্বাস্থ্যকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও ভয়ানক। কিন্তু তামাক বন্ধের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে।’

আরও পড়ুনঃ  হঠাৎ গরু শূন্য রাজধানীর পশুর হাট

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘দেশের বৃহত্তম সিগারেট কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর বাংলাদেশের পরিচালকদের মধ্যে সাতজন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব। করোনার সময় সিগারেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর কথা বলা হলে শিল্পসচিব তাতে বাধা দেন। ফলে আমাদের বায়ুদূষণ কমাতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।’

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় সারা দিনে একজন যে পরিমাণে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন, তা প্রায় দুটি (১ দশমিক ৭) সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতি করে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিবছরই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ এবং রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে স্থান পেয়েছে। ২০১৯ সালে বায়ুদূষণকে বাংলাদেশে মানুষকে মৃত্যু এবং অক্ষমতার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বড় ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। দেশে ২০১৯ সালে ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মৃত্যুর জন্য বায়ুদূষণকে দায়ী করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে ঢাকা ও সিলেটের ১২ হাজার ২৫০ জনের ওপর জরিপ চালিয়ে বায়ুদূষণের কারণে তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাবের মূল্যায়ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ঢাকায় সারা দিনে একজন যে পরিমাণে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন, তা প্রায় দুটি (১ দশমিক ৭) সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতি করে।

দূষণে প্রধান উৎস তিনটি

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ভেতরে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে প্রথমে আছে ঢাকা। ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার বরিশাল বিভাগ। অন্যদিকে সিলেট বিভাগে বায়ুদূষণ অপেক্ষাকৃত কম। দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে তিনটি খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই আছে যানবাহনের ধোঁয়া। যানজটের কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের ধোঁয়া বাড়ছে।

আরও পড়ুনঃ  উদ্ভাবন-দক্ষতায় শ্লথ বস্ত্রখাত

এরপরই রয়েছে শুষ্ক মৌসুমে অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের কারণে সৃষ্টি হওয়া ধুলা। এরপর দূষণের জন্য ইটভাটার ধোঁয়াকে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যানজট ও নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ বায়ুদূষণ হয়, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমানের চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি এবং ইটভাটার কারণে যে দূষণ হয়, তা ১৩৬ শতাংশ বেশি।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন বয়স্ক মানুষ, শিশু এবং যাঁদের ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগ আছে তাঁরা। দূষিত এলাকার প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্ট। নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য বক্ষব্যাধিও এসব এলাকার বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে দেখা গেছে।

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘কৃষিকাজের কারণে আমাদের দূষণ বাড়ছে। তাই বলে কৃষিকাজ তো আর বন্ধ রাখা যাবে না। একইভাবে নির্মাণকাজও আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। বন্ধ করার সুযোগ নেই। তবে এসব কাজের মাধ্যমে যে দূষণ হয়, তা কমানোর চেষ্টা করতে হবে।’

সচিব বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো কোনো জায়গায় খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। অনেক জায়গায় অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত থাকেন। তাঁদের ক্ষেত্রে কিছু করা যায় না। কর্মকর্তারা তাঁদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। তারপরও আমরা দায় এড়াতে পারি না। আমাদের পারতেই হবে।’

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ড্যান ড্যান চেন। তিনি বায়ুদূষণ রোধে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার ওপরে গুরুত্ব দেন।

আরও পড়ুনঃ  রাজশাহী যেন ‘সবুজ কন্যা’

প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বিশ্বব্যাংকের বায়ুদূষণ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইফফাত মাহমুদ এবং ওয়ামেক আজফার রাজা। প্রশ্নোত্তর পর্ব পরিচালনা করেন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ এক্সটার্নাল অফিসার মেহরিন আহমেদ মাহবুব।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন