ব্যাংক ও বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধ না হলে হুন্ডিও বন্ধ হবে না: রেমিট্যান্স যোদ্ধারা
অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অন্য যা কিছুই করা হোক হুন্ডি কমবে না: অর্থনীতিবীদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম
হুন্ডি বন্ধ করতে হলে হয়রানি বন্ধসহ প্রবাসীদের কাছাকাছি ব্যাংক সেবা পৌঁছে দিতে হবে: অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর
এক দেশ থেকে আরেক দেশে টাকা পাঠানোর একটি মাধ্যম হলো হুন্ডি। তবে এটি দেশের আইনে অপরাধ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি। বেড়ে যায় মুদ্রা পাচার। প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার এলে সেটা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হয়। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ এলে তা হয় না। তথ্য বলছে, প্রবাসীরা প্রতিবছর দেশে যে অর্থ পাঠায় তার ৪৯ শতাংশই আসে অবৈধ পথে বা হুন্ডিতে। বাকি ৫১ শতাংশ আসে বৈধ পথে।
মূলত, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হুন্ডি দিন দিন হয়ে উঠছে বেশি জনপ্রিয়। রেমিট্যান্সের হিসাব দেখলে যা সহজেই অনুমান করতে পারবে যে কেউ। একসময় রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ডের পর রেকর্ড হতো তা এখন প্রতিনিয়তই কমছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবাসীদের প্রাপ্য সম্মান না দেয়া, ব্যাংকের নানা নিয়ম, হয়রাণী, ডলারের দাম বেঁধে দেয়া এবং ব্যাংকের দুরবস্থার খবরে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার কারণেই হুন্ডির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। যা বাড়িয়েই চলেছে বিপদ।
উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মুঘল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিলো অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। যে কারণে প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মুঘল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ছিল ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে। এই দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি।
হুন্ডি সরাসরি প্রভাব ফেলছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। বিপদ বাড়াচ্ছে দেশের অর্থনীতির। হুন্ডি বন্ধে সম্প্রতি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রবাসী বাংলাদেশি ও তাদের প্রিয়জনদের জানানো যাচ্ছে যে, কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে (হুন্ডি বা অন্য কোনো অবৈধ পথে) প্রেরণ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এবং এতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আপনাদের অর্জিত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি বা অন্য কোনো অবৈধ পথে না পাঠিয়ে বৈধ পথে/ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ করুন। দেশ গড়ায় মূল্যবান অবদান রাখুন এবং আপনার প্রিয়জনকে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ রাখুন।
হুন্ডির জনপ্রিয়তা বাড়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ডলারের দাম। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের জন্য দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের মানি এক্সচেঞ্জ, বিদেশি ব্যাংক ও হুন্ডির রেট ভিন্ন ভিন্ন। ব্যাংকের বিনিময় হারের তুলনায় হুন্ডির রেট তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়। যে কারণে প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হন। যদিও সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তবুও প্রবাসীদের এদিকে আগ্রহ বাড়ছে না। কেন না প্রণোদনার চেয়েও বেশি বিনিময় মূল্য পাওয়া যায় হুন্ডিতে। এজন্যই ব্যাংকের বদলে হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন প্রবাসীরা। তাছাড়া প্রযুক্তির কল্যাণে হুন্ডি এখন আরো বেশি সহজ ও নিরাপদ হয়ে উঠেছে। চাইলে মুহূর্তেই লেনদেন করা যায় যখন-তখন।
একটা সময় হুন্ডি ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় লেনদেনকারীদের জন্য তা এখন অনেকটাই ঝামেলামুক্ত। বিদেশে বসে দেশে স্বজন-পরিজনদের কাছে টাকা পাঠানো শুধু একটা ফোনকলের ব্যাপারমাত্র। বিদেশের কর্মস্থল থেকে এজেন্টকে ফোন দিয়ে পরিমাণ বলে দিলেই তারা সমপরিমাণ টাকা পৌঁছে দিয়ে আসেন গ্রাহকের স্বজনের কাছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেন বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির সেবা। এছাড়া গ্রামে বা শহরে একেবারে গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়েও হাতে হাতে টাকা পৌঁছে দেন হুন্ডির কারবারিরা।
তথ্য বলছে, কর্মী বেশি থাকা দেশ থেকেই রেমিট্যান্স আসছে সবচেয়ে কম। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বৈধ পথে এ পর্যন্ত দেশের বাইরে গেছেন ১ কোটি ৪৫ লাখ কর্মী। এর মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন প্রায় ৩৬ শতাংশ। আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ লাখ ৭৫ হাজার কর্মী বাইরে গেছেন। এর মধ্যে ৫ লাখ ১৪ হাজার বা ৫৯ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। গত বছর ৬ লাখ ১৭ হাজার শ্রমিক যান সে দেশে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১৮ হাজার।
তবে শ্রমিক যাওয়া বাড়লেও দেশটি থেকে মোট রেমিট্যান্সে অংশ কমছে। করোনার বছর ২০২০ সালে মোট ২ হাজার ১৭৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্সের ২৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ আসে সৌদি আরব থেকে। পরের বছর সেখান থেকে মোট রেমিট্যান্সের ২৩ দশমিক ১৭ শতাংশ আসে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ অংশ আরও কমে ১৯ শতাংশের নিচে নেমেছে। গত বছরের জুলাই থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে শুরু করে। এখন এটি গড়ে প্রতি মাসেই কমছে। এ কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। এখন যদি হুন্ডি বন্ধ করা না যায় তাহলে রেমিট্যান্স বাড়ার সম্ভাবনা নেই। রেমিট্যান্স যদি না বাড়ে তাহলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে না। এতে আরো বেশি বিপদ বাড়বে সামগ্রীক অর্থনীতিতে।
গতকাল মঙ্গলবার এমনই এক চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে লিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইনান্সিয়াল ক্রাইম এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিট। সিআইডির ভাষ্যমতে, এই চক্র মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) দুই হাজার এজেন্ট সিমের মাধ্যমে প্রতি মাসে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন করতো। এর আগে প্রবাসী আয় দেশে আনতে অবৈধ ‘হুন্ডি’র মাধ্যমে অর্থ লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগে এমএফএস এর ৪৮০ এজেন্টের হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। এমন পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রবাসী আয় অবৈধভাবে দেশে পাঠানোদের বিরুদ্ধে ‘শাস্তি’ নেওয়া হবে বলে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাহরাইন প্রবাসী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, হঠাৎ বাড়ি থেকে একটা কল এলো। বললো যে জরুরিভাবে কিছু টাকা দরকার। তাৎক্ষণিক বিকাশ এজেন্টের কাছে গিয়ে টাকা দিলেই মুহূর্তেই বাড়ির লোকজন টাকা তুলে নিতে পারে। এতে কোনো প্রকার ঝামেলা পোহাতে হয় না। অথচ ব্যাংকে গেলে নানান ঝামেলায় পড়তে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দামও পাওয়া যায় কম। হয়রনির কথা তো আর বলে শেষ করা যাবে না। ওই প্রবাসী বলেন, হয়রানি বন্ধ না হলে হুন্ডিও বন্ধ হবে না।
দেশের বাইরে থেকে দেশে বিকাশের টাকা পাঠায় কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে যাদের কাছে টাকা দিই দেশে তাদের বিকাশ এজেন্ট আছে। সেই এজেন্টকে তারা দেশ থেকে মাসিক চুক্তিতে একটা টাকা এডভান্স করে। সেই এডভান্স টাকা থেকে এরা গ্রাহকের নাম্বারে টাকা ট্রান্সফার করে দেয়। মাস শেষে হিসাব করে তারা লাভ বুঝে নেয়।
এ বিষয়ে দৈনিক আনন্দবাজারের কথা হয় এমন এক বিকাশ এজেন্টের সাথে যিনি এ কাজে জড়িত। নাম প্রকাশ না করা শর্তে তিনি বলেন, বিদেশে এমন একজন ব্যক্তির সাথে তার পরিচয় আছে যিনি সেখানে হুন্ডির ব্যবসা করেন। সেই ব্যক্তি মাসের শুরুতেই দেশ থেকে অজ্ঞাত লোকের মাধ্যমে ব্যাংক একাউন্ট কিংবা নগদ দুই লাখ টাকা এডভান্স করেন। শর্ত হলো তিনি যখন যেখানে যত টাকা পাঠাতে বলবেন তা পাঠিয়ে দিবেন। এভাবেই তিনি দেশে বসে বিকাশে টাকা পাঠানোর মাধ্যমে আয় করেন বড় অংকের টাকা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির সঙ্গে রেমিট্যান্সের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে মইনুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকদের বেশিরভাগই এখন হুন্ডির আশ্রয় নিচ্ছেন। হুন্ডি ঠেকানোর সহজ কোনো উপায় নেই। সাধারণভাবে ব্যাংকের ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিকরা অর্থ পাচার করেন। যতদিন পাচারের চাহিদা থাকবে, হুন্ডি ততদিন চলবে। অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে অন্য যা কিছুই করা হোক, হুন্ডি কমবে না।
ব্যাংকের হয়রানির কারণেও বাড়ছে হুন্ডি। বিদেশ থেকে আনা মুদ্রা বিক্রি করতে গেলে ব্যাংকে অনেক সময়ই বিনিময়মূল্য কম পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ব্যাংকে প্রবাসী আয়ের অর্থ ভাঙাতে গেলে গ্রাহকদের পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। অনেক সময় বৈধ পরিচয়পত্র-এনআইডি না থাকা, পরিচয়পত্র বহনের সচেতনতার অভাবও ব্যাংক থেকে প্রবাসী আয় ওঠানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা। হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কোনো ফি নেই, বিপরীতে ব্যাংকে চার্জ কাটা হয়।
অনেক সময় বৈধপথে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো হলেও ব্যাংক থেকে তার স্বজনের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয় না। প্রবাসীরা ফোন করে জানানোর পর তারা ব্যাংকে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় কাউন্টারে। বিপরীতে হুন্ডি এজেন্টদের গ্রাহকরা ফোন দিলে তারা গ্রাহকের বাসায় টাকা ও বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসে। গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের থেকে হুন্ডির সেবা তাই সহজ, দ্রুত এবং নিরাপদ।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, হুন্ডির সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ফি কমিয়ে ব্যাংকিং সেবা বাড়াতে হবে। ডলারের দামে ব্যাংক ও খোলাবাজারের যে ব্যবধান তা কমিয়ে আনতে হবে। ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠালে অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে খরচ বেশি। হুন্ডিতে কোনো খরচ নেই।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, তাছাড়া বিদেশে প্রবাসীরা ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারেন না। ভাষাগত সমস্যার কারণে ব্যাংকের সেবা নিতে পারেন না। প্রবাসীরা যেখানে কাজ করেন তার চেয়ে অনেক দূরে ব্যাংক। যে কারণে প্রবাসীরা ব্যাংকমুখী হচ্ছেন না। প্রবাসীদের কাছাকাছি ব্যাংক সেবা পৌঁছে দিতে হবে। দেশে ব্যাংক সেবায় হয়রানি বন্ধ করতে হবে। এর পক্ষে প্রচারও বাড়াতে হবে। তাহলেই হুন্ডি বন্ধ করা সম্ভব হবে।