ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নেই শিল্পের বড়াই

নেই শিল্পের বড়াই
  • সচেতনতা ছাড়া পাখি তথা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্ভব নয়: মমতাজ বেগম, ইউএনও, পাইকগাছা 

কবি রজনীকান্ত সেনের ভাষায়, বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই…। হ্যাঁ আবহমান গ্রামবাংলার বাসা তৈরির যে নিখুত কারিগর, কবির কালজয়ী ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতার নায়ক সেই বাবুই পাখি শিল্পের বড়াই করতেই পারে। তবে তালগাছের স্বল্পতা আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বাবুই পাখি নিজেই আজ অস্তিত্ব সংকটে। কালের বিবর্তনে নেই শিল্পের বড়াই। তাই আর কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয় না গ্রামবাংলার জনপদ।

অথচ মাত্র ক’বছর আগেও গ্রাম্য মেঠোপথ কিংবা প্রতিটি বাড়ির আনাচে-কানাচে তালগাছের পাতায় পাতায় উুঁকি দিত মন ভুলানো বাবুই পাখি ও দৃষ্টিনন্দন বাসা। তবে এখন চিরচেনা সেই ছায়া সুনিবিড় গ্রামাঞ্চলেই বাবুইপাখি চোখে মেলানো ভার। মেঠোপথ বেয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটলেও চোখে পড়ে না ঐতিহ্যের বাহক বাবুই পাখি।

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় সুন্দরবন উপকূলীয় খুলনার পাইকগাছা থেকেও বাবুই পাখি আজ বিলুপ্ত প্রায়। বহুদিন চোখে পড়ে না তালগাছের পাতায় পাতায় ঝুলে থাকা নিপুণ কারিগর বাবুই পাখির বাসা। আর তরুণ প্রজন্ম যেন থমকে আছে বইয়ের পাতায়। নাম শুনলেও অধিকাংশেরই পাওয়া হয়নি চোখে দেখার সাধ। তবে মাত্র ১২/১৪ বছর আগেও এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠান কিংবা রাস্তার ধারের প্রতিটি তাল আর খেজুরগাছেও দেখা যেত দৃষ্টিনন্দন বাবুই পাখির বাসা।

প্রতিবেদন তৈরির আগে কয়েকদিন যাবত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাইলের পর মাইল ঘুরেও চোখে পড়েনি বাবুই পাখি কিংবা বাসা। অভিজ্ঞজনদের ধারণা, বছরের পর বছর নির্বিচারে তালগাছ নিধনে পাখির বসবাস উপযোগী পরিবেশ সংকট, ফসলি জমিতে অবাধে কীটনাশক প্রয়োগ, পাখি শিকারীদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি আর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এ অঞ্চল থেকে বাবুই পাখি বিলুপ্তির কারণ।

সাধারণত বাবুই পাখি অর্ধেক বাসা তৈরির পর স্ত্রী সঙ্গীর সম্মতি নিয়ে ৪ থেকে ৫ দিনে সম্পূর্ণ বাসা প্রস্তুতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দৃষ্টিনন্দন বাসা তৈরি করে থাকে। শুরুতেই তারা বাসার নিচের অংশে দু’টি গর্ত রাখে। আর বাসা প্রস্তুত সম্পন্ন হলে একদিকের গর্ত বন্ধ করে সেখানে ডিম রাখার উপযোগী করে তোলে। আর অপরদিকের গর্তটি দিয়ে বাসার ভেতরে যাতায়াত করে। তবে স্ত্রী সঙ্গীর বাসা অপছন্দ হলে অর্ধেক কাজ ফেলে রেখে নতুন করে বাসা তৈরি করে। এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, রাতে ঘর আলোকিত রাখতে জোনাকি ধরে নিয়ে বাসায় রাখে। সকাল হলেই তা আবার ছেড়ে দেয়।

একটি পুরুষ বাবুইপাখি মৌসুমে সর্বোচ্চ ৬টি বাসা তৈরি করতে পারে। এ কাজে তারা খড়, ঝাউ, তালপাতা, কাশ ও লতাপাতা ব্যবহার করে। ধান ঘরে ওঠার মৌসুম বাবুই পাখির প্রজননের সময়। স্ত্রী বাবুই পাখির তা দেওয়ার দু’সপ্তাহের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। তবে তিন সপ্তাহের মাথায় বাবুই পাখির বাচ্চা বাসা ছেড়ে উড়ে যায়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিশ্বে ১১৭ প্রজাতির বাবুই পাখির দেখা মিললেও বাংলাদেশে দেশি, দাগি এবং বাংলাসহ মাত্র ৩ প্রজাতির দেখা মেলে। এর মধ্যে আবার দাগি এবং বাংলা এ দুই প্রজাতির বাবুই পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে দেশি বা বাংলা বাবুই এখনো দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে চোখে পড়ে।

স্থানীয়রা মনে করেন, উপকূলীয় উপজেলায় আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের বাহক বাবুই পাখির শৈল্পিক নিদর্শনের অস্তিত্ব রক্ষায় জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি। আর প্রতিবছর মৌসুমের এ সময়ে উপজেলার কয়েকটি এলাকায় ব্যাপকভাবে অতিথি পাখি নিধন করা হয়। বাবুই বাখির অস্তিত্ব রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি ওই সকল পাখি শিকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানান তারা।

পাইকগাছা উপজেলা স্যানেটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক উদয় কুমার মন্ডল বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা তথা নিরাপদ জীবনযাপনে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানান তিনি।

পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম জানান, সচেতনতা ছাড়া পাখি তথা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্ভব নয়। তাই সম্মিলিতভাবে নিজ নিজ এলাকায় সে ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে উপকূলীয় অঞ্চলে পাখির বসবাস উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে সকলের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

সংবাদটি শেয়ার করুন