শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অগ্রাধিকারে গ্রামীণ প্রকল্প

অগ্রাধিকারে গ্রামীণ প্রকল্প

বিশ্বব্যাপী মহামন্দার ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে বাংলাদেশও। এমনকি সাম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ বিষয়ে বার বার সতর্ক হওয়ারও তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক আগে থেকেই বড় বড় প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধসহ সীমিত করার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। তবে তারপরও নানা ধরনের প্রকল্প অনুমোদন করা হচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহি কমিটি (একনেক) প্রায় ৩ হাজার ৯৮১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত ৭টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

এসব প্রকল্পের মধ্যে সরকারি অর্থায়ন হবে ৩ হাজার ৩৯২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। বৈদেশিক অর্থায়ন হবে ৩২২ কোটি ২১ লাখ টাকা। এছাড়া সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ২৬৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। প্রধানমন্ত্রী এবং একনেকের চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরস্থ এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়।

তবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আয়েশি-বিলাসী প্রকল্প নেওয়া যাবে না। ছোট গ্রামীণ প্রকল্প বা কল্যাণমুখী প্রকল্পে আপস করা যাবে না। বড় বড় প্রকল্প নেওয়া যাবে না। বড় প্রকল্প গ্রহণে ফিজিবিলিটি স্টাডি গভীরভাবে দেখতে হবে।

সভা পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী। বলেন, আগেরদিন সোমবার প্রধানমন্ত্রী এক সঙ্গে ১০০টি সেতুর উদ্বোধন করেছেন। যা উন্নয়নের একটি মাইলফলক। দেশে এর আগে এমন কোনো প্রকল্প হয়নি। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের সেতুটিকে স্থানীয়ভাবে হাওরের পদ্মা সেতু বলা হচ্ছে। জনগণের আগ্রহের বিষয় উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, তারা উন্নয়নমূলক প্রকল্প যেমন সড়ক, সেতু এসব চায়। দীর্ঘদিন পরে একনেকের সভায় সশরীরে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে মন্ত্রী বলেন, আগামীতেও উন্নয়ন প্রকল্প অব্যাহত থাকবে।

তবে প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প বাছাই ও বাস্তবায়নে আরো সচেতন হতে বলেছেন উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এখন থেকে অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে গ্রামীণপ্রকল্প। আর বড় বড় প্রকল্পের গভীরে যাওয়া হবে। এখনকার বৈশ্বিক মন্দার কারণে দুনিয়াব্যাপী টালমাটাল অবস্থা। বিলাসদ্রব্য এড়িয়ে চলতে হবে।

অর্থনীতি কঠিন সময় অতিক্রম করছে বলে উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমরা কঠিন সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। সারাবিশ্বই এই সময় পার করছে। বৈশ্বিক কারণে আমাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে উন্নয়নের গতিধারা ইতিবাচক আছে। প্রবৃদ্ধির দিক ভালো হয়েছে। এবার আমন ধান ভালো হয়েছে। সিত্রাংয়ে তেমন ক্ষতি হয়নি।

আরও পড়ুনঃ  পাঙ্গাস চাষে দিনবদল

একনেক সভায় অনুমোদিত প্রকল্প
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের “চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ (সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ) অংশের জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ” প্রকল্প; স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের “ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৪ এর ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অবকাঠামোসহ অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৪ এর সার্ভিস প্যাসেজসমূহের উন্নয়ন” প্রকল্প; গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালের “বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার বৈদ্যুতিক-যান্ত্রিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ জন্যান্য উন্নয়ন কাজ” প্রকল্প; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ২টি প্রকল্প যথাক্রমে “বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ (১ম সংশোধিত)” প্রকল্প এবং “নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন (জেড-২০৩১) (১ম সংশোধিত)” প্রকল্প এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের “দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন” প্রকল্প এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের “চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ (১ম সংশোধিত); প্রকল্প।

এছাড়াও ব্যয় ঠিক রেখে মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হলো: গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি “খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন (১ম সংশোধিত)” প্রকল্প; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১টি এবং “বরিশাল মেট্রোপলিটন ও খুলনা জেলা পুলিশ লাইন নির্মাণ (আন্তঃখাত সমন্বয়কৃত)” প্রকল্প; স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের “শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন (২য় সংশোধিত)” প্রকল্প।

প্রথম প্রকল্প নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে “চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ (সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ) অংশের জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ” প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯১৩ দশমিক ৭০ কোটি টাকা। এটি পুরোটাই সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ করা হবে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় প্রকল্প স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের “ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৪ এর ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অবকাঠামোসহ অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৪ এর সার্ভিস প্যাসেজসমূহের উন্নয়ন”। ৯৬৩ দশমিক ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটিতে সরকারি অর্থায়ন হবে ৭৭০ দশমিক ৬৪ কোটি ও অন্যান্য উৎস থেকে অর্থায়ন হবে ১৯২ দশমিক ৬৬ কোটি টাকা। তৃতীয় প্রকল্প গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের “বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার বৈদ্যুতিক-যান্ত্রিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ জন্যান্য উন্নয়ন কাজ”। এতে ব্যয় হবে ৯২ দশমিক ১৭ কোটি টাকা। এই অর্থের পুরোটায় সরকার বহন করবে।

আরও পড়ুনঃ  সূর্যমুখীতে পর্যটনের হাতছানি

চতুর্থ প্রকল্প হচ্ছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ২টি প্রকল্প যথাক্রমে “বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ (১ম সংশোধিত)”। এতে ব্যয় হবে ১১০৭ দশমিক ১২ কোটি টাকা। প্রথমে এটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৪৫ দশমিক ৫৩ কোটি টাকা। তারমধ্যে সরকার দেবে ৫১৩ দশমিক ০৫ কোটি টাকা। প্রথমে ধরা হয়েছিল ২৬৪ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে ভারত দেবে ৫৯৪ দশমিক ০৭ কোটি টাকা। প্রথমে দেয়ার কথা ছিল ৫৮১ দশমিক ২০ কোটি টাকা।

একনেকে প্রকল্পটিতে মোট ২৬১ দশমিক ৫৯ কোটি টাকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তারমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ২৪৮ দশমিক ৭২ ও ভারত সরকার ১২ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদ হচ্ছে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে প্রথমে মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

পঞ্চম প্রকল্পটি হচ্ছে “নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন (জেড-২০৩১) (১ম সংশোধিত)”। এতে ১৮৩ দশমিক ৪১ কোটি টাকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পুরো অর্থায়নই সরকারিভাবে হচ্ছে। প্রথমে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪২১ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা। প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০৪ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা। এখন সময় বাড়ানো হয়েছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। ষষ্ঠ প্রকল্পটি হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের “দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন”। ৬৫ দশমিক ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। পুরো অর্থায়নই হচ্ছে সরকারিভাবে।

সপ্তম প্রকল্পটি হচ্ছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের “চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ (১ম সংশোধিত); প্রকল্প। এতে ৫০২ দশমিক ৪১ কোটি টাকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তারমধ্যে সরকারিভাবে ১১৮ দশমিক ৩৭ কোটি টাকা ও অন্যান্য উৎস থেকে ৩০৯ দশমিক ৩৫ কোটি টাকা, নিজস্ব অর্থায়নে ৭৪ দশমিক ৬৯ কোটি টাকা।

আরও পড়ুনঃ  পানিতে করোনার উপস্থিতি পরীক্ষা করবে ওয়াসা

প্রথম সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৬১ দশমিক ২৯ কোটি টাকা, যা আগে ছিল ১৩৫৮ দশমিক ৮৮ কোটি টাকা। সেখানে সরকারিভাবে ৪৭২ দশমিক ২৯ কোটি টাকা, যা আগে ছিল ৩৫৩ দশমিক ৯২ কোটি টাকা। নিজস্ব অর্থায়নে ১৫৩ দশমিক ৬৮ কোটি টাকা, যা আগে ছিল ৭৮ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা। অন্যান্য উৎস থেকে ১২৩৫ দশমিক ৩২ কোটি টাকা, যা আগে ছিল ৯২৫ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা।

পাঁচটি ভৌত অবকাঠামোর প্রকল্প সন্দ্বীপের প্রকল্প দিয়ে কাজ শুরু করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। মামলাজটের কারণে ভৌত অবকাঠামোতে সময় অতিবাহিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে কাজ প্রায় শেষের দিকে। এখানে জেটি না করলে অন্যরা নিজেরা করতে চাচ্ছে।

ব্যাংকখাতে রিজার্ভ সংকট নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাওয়া হলে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, একনেক বৈঠকে এই বিষয়ে কোনো কথাবার্তা হয়নি। তবে তিনি বলেন, সারাবিশ্বই এখন মন্দার দ্বারপ্রান্তে। আমরাও তার বাইরে নই। মন্দা বা কঠিন সময় মোকাবিলায় কোনো প্রকল্প নেয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এটি বৈশ্বিক বিষয়। আমরাও এর শিকার।

একনেক সভার কার্যক্রমে অংশ নেন পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রিগণ। সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, এসডিজি’র মুখ্য সমন্বয়ক, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের সিনিয়র সচিব ও সচিব এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন