শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধরিত্রী বাঁচাতে উদ্বেগ

ধরিত্রী বাঁচাতে উদ্বেগ

সম্প্রতি জলবায়ু দুর্যোগে নাকাল পুরো বিশ্ব। চলতি বছরের গত কয়েক মাসে সারা বিশ্ব দেখেছে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যার আঘাত এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি অনেক দেশ। ভুগছে নানা সমস্যায়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের পিছনে গুটি কয়েক উন্নত দেশের হাত থাকলেও এর ফল ভোগ করতে হয় ছোট-বড় সকল রাষ্ট্রকেই। যেটাকে খুবই অমানবিক বলছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তারা বলছেন, প্রতি বছর কপ সম্মেলনে জলবায়ু নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও এর বাস্তবায়ন খুবই কম হয়। যার প্রতিদান দিতে হয় ছোট ছোট দেশগুলোকে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে বিপর্যস্ত পৃথীবিকে রক্ষায় রবিবার মিশরে শুরু হয়েছে কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলন। এ সম্মেলনে বিশ্বের বহু রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ হাজার হাজার নেতা অংশ নেবেন। মোট ১৩ দিনব্যাপী সম্মেলনের এবারের আয়োজনে ১৯৮টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।

কনফারেন্স অব দ্য পার্টিসের সংক্ষিপ্ত রূপ কপ। এটি বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিপর্যয় মোকাবিলায় জাতিসংঘের একটি উদ্যোগ। ১৯৯৫ সালে কপের প্রথম সম্মেলন হয়। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিতে কপের জলবায়ু সম্মেলনে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ ইস্যুটি প্রথমবারের মতো সামনে আসে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। সবশেষ গত বছর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপের ২৬তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

কপ-২৭ হল জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসি) কনফারেন্স অব দ্য পার্টির ২৭তম সভা। এই বার্ষিক সভাটি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশে আলোচনায় বসতে ইউএনএফসিসি কনভেনশনের ১৯৮ জন সদস্যকে একত্রিত করে থাকে।

বৈঠকে, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন (গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস যা আমাদের এই পৃথিবীকে ক্রমশ উষ্ণ করে তোলে), জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশগত প্রভাবগুলির সাথে অভিযোজন, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে সরে আসা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে মানিয়ে নিতে আরো দুর্যোগ সহনশীল হবার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সহায়তার পথ চিহ্নিত করার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে।

জাতিসংঘ গত সপ্তাহে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে অপর্যাপ্ত’। আর এর অর্থ হচ্ছে, বিশ্ব এখন ‘বিপর্যয়ের মুখে’ রয়েছে। কপ-২৭ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষোভকে অবমূল্যায়ন করবেন না। মহাসচিব আরো বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো মনে করে, উচ্চ আয়ের দেশগুলো ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিস সম্মেলনে সম্পাদিত যুগান্তকারী জলবায়ু চুক্তিটি বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়।

আরও পড়ুনঃ  টিসিবির লাইনেও সিন্ডিকেট

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কপ-২১ সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো প্যারিস চুক্তিতে অনুমোদন দেয়। এই প্যারিস চুক্তি ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় রাষ্ট্রসমূহের করণীয় নির্ধারণে একটি যুগান্তকারী চুক্তি। যার অধীনে প্রতিটি দেশ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় অভিযোজন ব্যবস্থা সম্পর্কে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করবে। যা আসলে বৈশ্বিক উঞ্চতা “প্রাক-শিল্প স্তরের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে” নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি সম্মিলিত এবং সমন্বিত উদ্যোগ। সেসময় সরকারগুলো বৈশ্বিক উঞ্চতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখার মতো একটি উচ্চাকাঙ্খী লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে।

২০০৯ সালে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি প্রশমনে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত বিশ্ব বছরে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে। ২০২০ সালে ওই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু প্রায় তিন বছর পর এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ বছর ভয়াবহ বন্যা ও দাবদাহের কবলে পড়েছে পাকিস্তান। বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনই এর কারণ। এর সুবাদে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ১৩৪টি উন্নয়নশীল দেশের জোটের সভাপতি দেশ হিসেবে পাকিস্তান ক্ষতিপূরণের বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে।

যুদ্ধে উন্নত বিশ্ব কত অর্থ ব্যয় করছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি প্রসঙ্গে পাকিস্তানের জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রী শেরি রেহমান বলেন, আমি মনে করি না যে এটি কোনো অসম্ভব চাওয়া। আয়োজক মিসর সতর্ক করে দিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পেলে সম্মেলনকে ঘিরে ‘আস্থার সংকট’ তৈরি হবে। নিরাশ হয়ে এবারের সম্মেলনে যাচ্ছেন না সুইডেনের তরুণ কিন্তু প্রভাবশালী জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। অন্যদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব এবারের সম্মেলনকে উন্নত বিশ্বের জন্য ‘লিটমাস পরীক্ষার’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।

জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনও ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য থেকে অনেক পিছিয়ে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ সেন্টিগ্রেড মাত্রার নিচে রাখার অঙ্গীকার করেছে বিশ্ব সম্প্রদায়। তবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারের পরিকল্পনা এখনও অপর্যাপ্ত। পরিবেশবাদী নেতারা উন্নত দেশগুলোকে আরও বেশি পদক্ষেপ নিতে বলছেন।

আরও পড়ুনঃ  পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর ২০২৩: ইইউ

কপ- ২৭ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহনের ক্ষেত্রে একটি বাঁচা-মরার মুহূর্ত। পৃথিবী এই মুহূর্তে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখার মতো অবস্থায় নেই। আর গত বছরের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলির পরে এই বাস্তবতা আরো প্রকট হয়ে উঠেছে।
কোভিড-১৯ এর ফলে সৃষ্ট চলমান অর্থনৈতিক প্রভাব, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ এবং বিভিন্ন দুর্যোগের আকারে জলবায়ু পরিবর্তনের বাড়তি প্রভাবের ফলে জলবায়ুতে কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনাসহ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য বিশাল বাধা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় প্যারিস চুক্তিটি অপ্রাসঙ্গিকতার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। একটি সফল কপ ২৭ যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।

এদিকে গত বছর জলবায়ু সম্মেলন (কপ ২৬) অনুষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে এবং শেষ হয় গ্লাসগো জলবায়ু ঐক্যমতের মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে কয়লা বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিসহ জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করা। কপ ২৬ -এ প্যারিস রুলবুকটিও চূড়ান্ত করা হয়, যা আর্টিকেল ৬ নামে পরিচিত যার মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হয়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কপ– ২৬ ছিল একটি বড় হতাশার জায়গা। কারণ এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করা হচ্ছিল। অথচ গত বছর এই ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। গ্লাসগো সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষয়ক্ষতি এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তা কথা স্বীকার করলেও, তা কাটিয়ে উঠতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার বিষয়ে কোনো সুষ্পষ্ট দিক নির্দেশনা ছাড়াই শেষ হয় সেবারের আসর।

এবারের সম্মেলনে ১১ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাউডেন যোগ দেবেন। সেখানে তিনি জলবায়ু নিয়ে কাজ করার বিশ্বের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবেন বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাইডেন বৈশ্বিক জলবায়ু মোকাবিলার যুদ্ধে এগিয়ে আসবেন ও জলবায়ুর প্রভাবের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্বলদের স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করবেন। তিনি দৃঢ়সংকল্পের এই দশকে জলবায়ু নিয়ে বিশ্বের সঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবেন।

আরও পড়ুনঃ  দেশে করোনার আরও একটি ঢেউ আসতে পারে

হোয়াইট হাউস জানায়, তিনি জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং ক্রয়ক্ষমতাসহ জলবায়ু পরিবর্তন, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জি২০ অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করবেন। তিনি বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের সঙ্গে কাজ করবেন। অপরদিকে সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না সদ্য দায়িত্ব নেয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। হয়তো দুই দেশ থেকে প্রতিনিধি দল যেতে পারে।

ঋষি সুনাকের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যুক্তরাজ্য নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে। গত শুক্রবার তিনি বলেন, জলবায়ু বিষয়ে আমরা যে নেতৃত্ব দেখিয়েছি, সারা বিশ্বে তা অতুলনীয়। তিনি বলেন, কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনে মিশরে না গিয়ে ‘নিজ দেশের জরুরি সমস্যায়’ মনোযোগ দেয়া বেশি দরকার। ব্যক্তিগতভাবে আমি এসব সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু অর্থনীতি নিয়ে আমাদের যে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ আছে, এ মুহূর্তে আমি সেটির দিকে মনোযোগ দেয়াকেও ঠিক মনে করি।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুনাকের পূর্বসূরী লিজ ট্রাস চেয়েছিলেন অন্তত একদিনের জন্য হলেও এই সম্মেলনে যোগ দেবেন। কিন্তু সুনাকের মুখপাত্র বলেছেন, তার উপর অভ্যন্তরীণ চাপ থাকার কারণে তিনি যাচ্ছেন না।

ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্ব জলবায়ু ইস্যুতে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করলেও নগদ সহায়তার বিষয়ে তাৎক্ষণিক কিছু জানায়নি। আগামী বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় ক্ষতিপূরণ নিয়ে উন্নত বিশ্ব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেনে রুশ সামরিক আগ্রাসনের জেরে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা সমস্যা দেখা দেওয়ায় উন্নত দেশগুলো নিজ নিজ অর্থনীতির দিকেই বেশি দৃষ্টি দিচ্ছে। তবে শীর্ষ দুই দূষণকারী যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় দেশের ভূমিকা সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ হবে, যা আগেও ছিল।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন