শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চা রপ্তানিতে শঙ্কা

চা রপ্তানিতে শঙ্কা

দেশে ক্রম সম্প্রসারণশীল সম্ভাবনাময় চা-শিল্পে হঠাৎ করেই ছন্দপতন ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন বাগানে টানা ২০ দিন ধরে শ্রমিক আন্দোলনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে চা শিল্পে। বাগানে কাজ বন্ধ রেখে মজুরির দাবিতে করা শ্রমিক আন্দোলনের ফলে চা উৎপাদন দারুণভাবে ব্যবহত হয়েছে। দেশে অভ্যন্তরীণ বাজারে চা পাতার যে চাহিদা রয়েছে, সে তুলনায় জোগান না থাকায় বাজারে চায়ের দাম বেড়ে গেছে।

চা শিল্পের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই চায়ের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। আগে যেখানে প্রতি কাপ চায়ের দাম ছিল ৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮/১০ টাকা। এখন ক্ষেত্র বিশেষে লাল চা ও গুড়ো দুধের চা বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা পর্যন্ত। সম্প্রতি দেশজুড়ে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে সরকার শ্রমিকদের মজুরি ৫০ টাকা বৃদ্ধি করে। এতে নতুন করে চায়ের দাম বাড়ানোর সুযোগ সন্ধান করছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। যদিও বিষয়টি নিয়ে চা বোর্ডের কিছুই করার নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, চায়ের উৎপাদন বাড়লেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে গিয়ে কমেছে রপ্তানি।

সূত্রমতে, সাধারণত দেশে কারখানা থেকে চা উৎপাদন হওয়ার পর চা দুইভাবে বিক্রি হয়। একটি অকশনে আরকটি খোলা বাজারে। এর দাম নির্ধারণ করে দেয় চা বোর্ড। তবে এর বাইরেও খোলা বাজারে বিপুল পরিমাণ চা পাতা বিক্রি হয়। যার নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। বিভিন্ন মহলের অভিযোগ মালিকপক্ষ অকশনে খারাপ চা পাঠিয়ে থাকে আর খোলা বাজারে যায় ভালো চা। এছাড়া বেশ কিছু কোম্পানি তাদের প্যাকেট জাত চা বাজারে ছেড়েছে। যেগুলোর দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ)।

আরও পড়ুনঃ  কৃষিতে বিমুখ তরুণ প্রজন্ম

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলছেন, খোলাবাজারে চা পাতার দাম বৃদ্ধি করা অযৌক্তিক। এতে  সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়তে পারে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের বেশ কিছু সংস্থা কাজ করছে। আশা করছি জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে চায়ের দাম।

শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির পর বাজারে চা পাতার দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘চা বোর্ড সাধারণত অকশনে চায়ের দাম নির্ধারণ করে দেয়। যে কোনো দ্রব্যের দাম বাড়ে-কমে সাধারণত চাহিদা ও যোগানের ওপর ভিত্তি করে। চায়ের ক্ষেত্রেও তাই।

এদিকে, ইস্পাহানি, এইচআরসি, সীলন, ফিনলে, ন্যাশনাল টিসসহ প্রায় শতাধিক কোম্পানি বাজারে প্যাকেট জাত চা বিক্রি করে আসছে। ১ কেজি, ৫০০ গ্রাম থেকে ৪০ গ্রাম পর্যন্ত চায়ের প্যাকেট খেলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। কোম্পানি ভেদে এগুলোর একেকটার একেক দাম লক্ষ্য করা গেছে। ইস্পাহানি ৫০০ গ্রামের একটি প্যাকের দাম ১৭৮ টাকা। একই ওজনের সিলন ৫০০ গ্রামের দাম ১৮৮ টাকা। তার চেয়ে কম ওজনের তাজা ৪০০ গ্রাম চা পাতার প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়।

চলতি বছরের জুলাইয়ে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার অস্থায়ী নিলাম কেন্দ্র বছরের পঞ্চম চা নিলামে প্রায় ৪ কোটি ১২ লাখ টাকার চা বিক্রি হয়েছে। নিলামে শ্রীমঙ্গলের ৫টি ব্রোকার্সসহ শতাধিক বায়ার অংশ নেন। পাঁচটি ব্রোকার্সের মাধ্যমে চা নিলামে ৩২টি বাগানের মোট ২ লাখ ৫ হাজার ৯৭৩ কেজি চা তোলা হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে চা বিক্রি হয় হবিগঞ্জের বৃন্দাবন চা বাগানে ২৪০ টাকা প্রতি কেজি দরে। দেশের চায়ের চাহিদার প্রায় ৫৫ ভাগই পূরণ করে থাকে মৌলভীবাজার জেলার বাগানগুলো। এ ছাড়া সিলেট অঞ্চলের বাইরে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা থেকে আসে উৎপাদিত চায়ের দশ ভাগ।

আরও পড়ুনঃ  `বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে'

আশঙ্কাজনক হারে কমেছে চা রপ্তানি

চা বোর্ডের তথ্য মতে, চলতি ২০২২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৩ লাখ কেজি। আগের বছর উৎপাদন হয়েছিল ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি। যদিও ২০২০ সালে উৎপাদন হয়েছে ৮ কোটি ৬৩ লাখ কেজি চা।

চা রপ্তানি করে ২০২০ সালে ৩৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা আয় হয়েছে। এরপর  ২০২১ সালে ১৮ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং চলতি ২০২২ সালে জুলাই পর্যন্ত আয় হয়েছে ১১ কোটি ৩ লাখ টাকা। চা রপ্তানি করে ২০০১ আয় হয়েছিল ৮৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং ২০০৫ সালের ৭৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ চায়ের উৎপাদন বাড়লেও এই খাত থেকে ধারাবাহিক ভাবে কমেছে রপ্তানি আয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চায়ের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ার কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির যোগ্য চা খুব একটা থাকে না। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদেশে রপ্তানি বাড়াতে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশে জনপ্রিয় জাতের চা উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে।

সম্প্রতি চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম বলেন, চা শিল্প জিডিপিতে ১ শতাংশ অবদান রাখছে। এটাকে অন্য শিল্পের সঙ্গে মিলানোর সুযোগ নেই। শ্রমিকরা নগদ দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পান। পাশাপাশি তারা ২ টাকা দরে ৪২ কেজি চাল বা আটা পান। এছাড়া বিভিন্ন ছুটি, উৎসব, ভাতা, বিনামূল্যে আজীবন গৃহায়ণ, চিকিৎসা, চাষের জমি, পশুপালন চারণ ভূমি, পেনশনসহ অনেক কিছু পান। সেগুলো হিসাব করলে একজন চা শ্রমিক দৈনিক গড়ে ৪০০ টাকার কাছাকাছি বা তারও বেশি কেউ কেউ মজুরি পেয়ে থাকেন।

আরও পড়ুনঃ  ঢাবিতে স্বাস্থ্যবিমায় ঢিলেমি

মো. শাহ আলম আরও জানান, বিগত কয়েক দশকে যেখানে চায়ে উৎপাদন ২৩.৯ মিলিয়ন কেজি থেকে ২০২১ সালে ৯৬.৫ মিলিয়ন কেজির বেশি হয়। তারপরও অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন সামান্য পরিমাণ চা রপ্তানি হয়। ১৬৮ বছরের পুরানো এই শিল্পের বার্ষিক মূল্যমান গত বছর ৩৫০০ কোটি টাকা। আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্প হিসাবে কাজ করছে। পৃথিবীতে চা উৎপাদনে ৩ শতাংশ অবদান রাখছে বাংলাদেশ।

সংবাদটি শেয়ার করুন