রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নগরের নিয়তি ‘জলযন্ত্রণা’

নগরের নিয়তি ‘জলযন্ত্রণা’
  • সিলেট মহানগরীতে কিছুদিন পরপরই জলাবদ্ধতা
  • অল্প বৃষ্টিতেই তলিয় যায় বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

‘জলযন্ত্রণার’ নিয়তি পিছু ছাড়ছে না সিলেট মহানগরবাসীর। অল্প বৃষ্টিতেই নগরীতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা, ভোগান্তিতে পড়তে নগরবাসীকে। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে জনমানসে। শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও জলাবদ্ধতা থেকে কেন মুক্তি মিলছে না, প্রশ্ন সবার। চলতি বৃষ্টির মৌসুমে বেশ কয়েকবার জলমগ্ন হয়েছে সিলেট নগরী। গত জুলাই মাসেও জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন নগরবাসী। তখনও ১২২৮ কোটি টাকা কোথায় গেল, সেই প্রশ্ন ওঠে জোরেশোরে।

সর্বশেষ গতকাল সোমবার সকালে তিন ঘণ্টার ভারি বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয় সিলেট। সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ে মানুষের বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। নগরবাসী পড়েন চরম ভোগান্তিতে।

জানা গেছে, ভারি বৃষ্টিতে ফলে মহানগরীর জিন্দাবাজার, বারুতখানা, হাওয়াপাড়া, রাজারগলি, উপশহর, যতরপুর, ছড়ারপাড়, ভাতালিয়া, জল্লারপাড়, তালতলা, চৌহাট্টা, সুবিদবাজার, ঘাসিটুলা, শামীমাবাদ, শিবগঞ্জ, নয়াবাজার, খাসদবির, মেডিকেল রোড, মজুমদারিসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক তলিয়ে যায়। অনেক এলাকায় সড়কে হাঁটুপানি জমে। সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ে মানুষের বাসা-বাড়িতে। অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়ে পানি। বিশেষ করে নিচু এলাকায় বসবাসরত মানুষেরা দুর্ভোগে পড়েন বেশি। শুধু পানি-ই ঢকেনি, ড্রেনের ময়লা-আবর্জনামিশ্রিত পানি ঢুকে পড়ে অনেকের বাসা-বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে।

নগরীর সুরমা নদী তীরবর্তী ছড়ারপাড় এলাকার বাসিন্দা ঝিলু মিয়া বলেন, ‘জলাবদ্ধতার কষ্টের কথা বলে লাভ নাই। আমরা থাকি বাসার নিচতলায়। বৃষ্টি হলেই আমরা আতঙ্কে থাকি, এই বুঝি বাসায় ঢুকে পড়লো পানি! আজও (সোমবার) ঘরে ঢুকেছে পানি। জিনিসপত্র নিয়ে টানাটানি করতে করতে আমরা হয়রান।’

আরও পড়ুনঃ  কেউ নির্বাচনে না আসলে সেই দায়িত্ব আমাদের না -নির্বাচন কমিশনার

সড়ক জলমগ্ন হয়ে পড়ায় চলাচলেও ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। গতকাল সকালে অফিসে যাওয়ার বেরিয়েছিলেন শিবগঞ্জের শাকিল জামান। কিন্তু জলমগ্ন সড়কে যানবাহন না পেয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি বাসায় ফিরে যান।

অপরদিকে, জলাবদ্ধতার পানি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের নিচতলায়ও ঢুকে পড়ে। ফলে গতকালের ক্লাস ও পরীক্ষা সকালে স্থগিত করা হয়। পানি নেমে যাওয়ার পর বিকালে ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

নগরবাসীর অভিযোগ- জলাবদ্ধতার পেছনে শুধু ভারী বৃষ্টিই দায়ী নয়, এর পেছনে সিটি করপোরেশনের কর্তাদেরও দায় আছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করার পরও নগরীতে যখন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, তখন সংশ্লষ্ট কাজে গাফিলতি আছে। এছাড়া ছড়া-খাল, নালা-নর্দমা নিয়মমাফিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করাও জলাবদ্ধতার অন্যতম একটি কারণ।

সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীতে ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। এসব ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও (খাল) আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। নালা-নর্দমায় প্রায় সাড়ে ৬শ’ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে।

সিসিকের প্রকৌশল শাখা সূত্র জানায়, বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মেয়র থাকাবস্থায় ২০০৯ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনে ছড়া-খাল খনন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১২ সালে ২৭টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন নির্মাণে ব্যয় করা হয় ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে সিসিক মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ওই বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন খাতে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১৬ থেকে ২০১৯ অবধি ২৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।

আরও পড়ুনঃ  এক যুগে হয়নি এক ইঞ্চিও

২০১৯ সালে ‘সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাসন্তবায়নে বরাদ্দ আসে ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; যা বাস্তবায়ন করছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।

এই প্রকল্পের আওতায় দুই অর্থবছরে সিসিক ৩২৯ কোটি টাকা পেয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটির আওতায় অন্যান্য কাজের সাথে ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেন ও ৮ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। আরসিসি রাস্তা, আরসিসি ড্রেন ও আরসিসি ড্রেনসহ ফুটপাত নির্মাণ খাতে প্রকল্পটির সিংহভাগ বরাদ্দ ব্যয় হওয়ার কথা রয়েছে।

জলাবদ্ধতার বিষয়ে সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী বলেন, ‘আজ (সোমবার) সকালে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এতো বৃষ্টিপাত সাধারণত সিলেটে হয় না। তবে এক ঘন্টার মধ্যে পানি নাই (নেমে যায়)।’ তিনি বলেন, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জের (জলবায়ু পরিবর্তন) কারণে সিলেটে নিত্যনতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যেটা আগে সিলেটে ছিল না।’

বিধায়ক চৌধুরী আরও বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে আমাদের যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো চলছে। যদিও বরাদ্দ সেভাবে মিলছে না, তবে কাজ চলমান আছে। আমি এটা বলতে পারি, গত দুই-তিন বছরে সিলেটে যে ড্রেনেজ সিস্টেম দেওয়া হয়েছে, এটা এর আগে কখনোই হয় নাই। আমি জোর গলায় বলতে পারি। এখন কথা হচ্ছে, ত্রুটি থাকতে পারে। ত্রুটি আমাদের আছে, নাগরিকের আছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেরও আছে। বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে ফেলা, যেখানে-সেখানে না ফেলা হচ্ছে নাগরিকের দায়িত্ব। রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ময়লা-আবর্জনা ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের লোকজন সময়মতো যায় না। ড্রেনের ছিদ্রগুলো যে পরিষ্কার করবে, সঠিক সময়ে যায় না।’

আরও পড়ুনঃ  যশোর থেকে শোভাযাত্রা চারুকলায়

সিসিকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মাধ্যমে আমরা নিয়মিত শ্রমিক দিয়ে কাউন্সিলরদের তদারকিতে কাজ করানো হয়। কিন্তু এতো কিছুর পরও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। যদি আমরা মালনিছড়া, লাক্কাতুরা, দলদলি এসব চা বাগানের পানিকে ডাইভার্ট করে, প্রয়োজনে খাল খনন করে অন্যদিকে নিতে পারি, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আরেকটি বিষয়, সুরমা নদী দীর্ঘদিন ধরে খনন করা হয় না। এটা করাও জরুরি। এ ছাড়া উন্নয়নের ফলে নিচু এলাকা, জলাধারগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জলাধারগুলোও বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।’

বিধায়ক চৌধুরী আরও জানান, সিলেটের উন্নয়নে ১২২৮ কোটি টাকা শর্ত সাপেক্ষে বরাদ্দ দিয়েছিলো সরকার। এই পরিমাণ অর্থ পেতে বিধি অনুযায়ী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সিলেট সিটি করপোরেশনকে নিজস্ব আয় থেকে ২০ শতাংশ অর্থাৎ, ২৪৫ কোটি যুক্ত করতে হবে। ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ৯৮২ কোটি টাকা সরকার দেবে। বরাদ্দের পুরো টাকা চারটি অর্থ বছরে ছাড় দেওয়া হবে। এই বরাদ্দের প্রথম ধাপে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ১২৯ কোটি টাকা পায় সিসিক। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দুইশ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। এখন পর্যন্ত ৯৮২ কোটি টাকার মধ্যে সিসিক পেয়েছে ৩২৯ কোটি টাকা।’

সংবাদটি শেয়ার করুন