শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সিপিডির আলোচনায় বিশেষজ্ঞ মত-

উসকে দেয়া মূল্যস্ফীতি

উসকে দেয়া মূল্যস্ফীতি

সুশাসনের অভাব আর অব্যবস্থাপনার কারণেই মূলত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার দায় চাপানো হয়েছে জনগণের ওপর। জ্বালানির দাম বাড়ার প্রভাব চলমান মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গিয়ে কমে যাবে লাভ। এখানে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তাই করা হয়নি। অথচ ভোক্তার ওপরে দায় না চাপিয়েও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারতো।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) কার্যালয়ে ‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন এড়ানো যেত কি?’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন ও আলোচনা সভায় এমন মন্তব্য করেছেন বক্তারা।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) গত ছয় বছরের চিত্র তুলে ধরে বক্তারা আরও বলেন, বিপিসি ৬ বছরে ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। এর মধ্যে সরকারের ঘরে গেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি কোথায় গেছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন, বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রমুখ।

সভায় সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সারাবিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমছে অথচ আমাদের দেশে বৃদ্ধি করা হলো। কেউ বলছে আমাদের দেশ থেকে নাকি অন্যদেশে কম। আপনারা দেখতে পারেন নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোথাও তেলের দাম বাড়তি নেই। ভিয়েতনাম উদীয়মান অর্থনীতির একটা দেশ অথচ দেখেন ভিয়েতনামে ডিজেলের লিটার প্রতি দাম ৯৭ দশমিক ৯ টাকা।

ড. ফাহমিদা খাতুন বিভিন্ন দেশের তেলের দামের তুলনা করে বলেন, আমরা কার সঙ্গে কী তুলনা করছি? আমরা বলছি হংকং এ নাকি জ্বালানি তেলের দাম আরও বেশি। এটা ঠিক আছে। কিন্তু হংকং এ মাথাপিছু আয় ৪৯ হাজার ৬৬০ ডলার। আমাদের ২ হাজার ৫০৩ মার্কিন ডলার। সুতরাং কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করতে হলে মাথাপিছু আয়ও দেখতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। যাতায়াত ব্যবস্থার খরচ বেড়ে যাবে। বাসভাড়া, ট্রাক ও লঞ্চভাড়া বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে ভাড়া বেড়ে গেছে।

আরও পড়ুনঃ  সন্ধ্যায় বিএনপির সংবাদ সম্মেলন

সিপিডি নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষি খাতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অনেক কৃষক ডিজেলচালিত পাম্প ব্যবহার করেন। কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। কৃষি উৎপাদন কমে যাবে। ফলে আমাদের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। এই মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনা। এটা এমন একটা সময় এলো যখন কি না আমাদের অর্থনীতি বিভিন্ন ভাবে চাপে রয়েছে।

ফাহমিদা বলেন, বিপিসি এককভাবে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেকে কোভিড থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তার ওপরে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সবাই চাপে পড়ছে। সাধারণ মানুষ ধাপে ধাপে নানাভাবে বিপদে পড়েছে। সাধারণ মানুষ কীভাবে বাঁচবে? যারা দিন আনে দিন খায় তারা কীভাবে পোষাবে। এসব বিবেচনায় কিন্তু নেওয়া হয়নি।

সিপিডি গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত সাত বছরে (২০১৫-২১) বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা লাভ করেছে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা গেল, সে প্রশ্ন রাখেন তিনি। চলতি বছরে তেল বিক্রি করে ১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা লাভ করলেও ৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা লোকসানের কথা বলছে বিপিসি। ত্রুটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। তাই প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের সামনে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন এ গবেষক।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়? ১০ হাজার কোটি টাকা সরকার নিয়েছে। বিপিসির বাকি টাকা কোথায় গেল? শুনেছি প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু টাকা খরচ করছে। আমরা দেখছি বিপিসি নাকি সবচেয়ে ধনি গ্রাহক। বিপিসির ২৫ হাজার কোটি টাকা অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে। তাহলে এসব টাকা কার? বিপিসি চাইলে এই সংকট সময়ে জ্বালানি তেলের ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে পারতো।

আরও পড়ুনঃ  মার্চ মাসের বেতন পাইনি ১৩ শতাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ১২৬ কোটি, ২০১৬ সালে ৯ হাজার ৪০ কেটি, ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। এছাড়া ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭৬৮, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৬৭ এবং ২০২১ সালে বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা লাভ করেছে। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য পেয়েছি। বিপিসি সব সময় জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ করেছে। তাহলে এখন কেন ভর্তুকি তুলে নেওয়া হলো?

বিকেএমইএ-এর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেছেন, বর্তমানে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। এমনিতেই আমরা নানা সমস্যায় আছি। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাবে। অনেক শ্রমিক খরচ মেটাতে পারবে না, তারা গ্রামে চলে যাবে। এতে আমাদের শিল্প বন্ধ হবে।

ফজলে শামীম এহসান বলেন, ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিক বিপদে পড়বে। নিত্যপণের দাম বাড়লে পোশাকশ্রমিক কাজে মন দিতে পারবে না। দাম বৃদ্ধির কারণে ডিজেল দিয়ে শিল্প চালু রাখা ফিজিবল না। এক্সপোর্ট পজিশন ভালো না। এখন ডলার ক্রাইসিস। আমরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি। কারণ বায়ারের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিতে পারছি না। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। শ্রমিক গ্রামে চলে যাবে।

বিকেএমইএ-এর সহ-সভাপতি আরও বলেন, ডিজেলের প্রাইস কমানো যেত কি না বলতে পারবো না। তবে এতে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুণ। তেলের দাম বৃদ্ধিতে দ্রব্যমূল্য কতটুকু বৃদ্ধি পাবে এটা সরকারকে ঠিক করতে হতো। ডিজেলের সুযোগে অনেক কিছুর দাম বাড়ছে। আমাদের পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। ডিজেলের দাম না কমালে শিল্প কারখানা বন্ধ করে বসে থাকা ছাড়া কোনো পথ নেই।

আরও পড়ুনঃ  চলমান ৫৫ প্রকল্পে ঋণ

আলোচনায় অংশ নিয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমরা ভর্তুকি কেউ পছন্দ করি না, কিন্তু হঠাৎ জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম চাপিয়ে দেওয়া হলো। আমরা এটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছি। সরকার এত সাহস করলো কীভাবে? জ্বালানি তেলকে রাজস্ব আয়ের জন্য সরকার ব্যবহার করছে। পরোক্ষভাবে রাজস্ব নিতেই তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ড. ইজাজ হোসেন আরও বলেন, হঠাৎ করে কেন এটা করা হলো? পরিবহন ও কৃষিতে অনেক ক্ষতি হবে। উন্নয়নশীল দেশে ডিজেলে ভর্তুকি দিয়ে থাকে একটা স্বীকৃত বিষয়। উন্নত দেশ ফুয়েলের দাম কমায়। সরকার এমন একটা সময় দাম বাড়িয়ে দিলো, যখন আমরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। বর্তমানে চালের দাম বেশি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের দামও বেশি। ভোজ্যতেলের দামও বেশি। সরিষার তেল ১৯৭৫ সালে ব্যবহার করতাম কিন্তু এখন শতভাগ আমদানিতে চলে গেছে। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম এমনভাবে বাড়ানো হয়েছে কেউ যুক্তিও খুঁজে পাচ্ছে না।

টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ আরও বলেন, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। এলিপিজির দামও বৃদ্ধি হয়েছে। এটা জনগণ মেনে নিয়েছে। সরকার এটা রাজস্ব আয়ের জন্য ব্যবহার করছে। বিশ্বে তেল থেকে রাজস্ব আয়ের টেনডেনসি আছে। তবে ডিজেলের দাম সব দেশেই কম রাখে। ডিজেলের ভর্তুকি না দিলে অনেক রকম ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে খারাপ সময়ে আছি। তেলের দাম বৃদ্ধিতে সবাই বিপদে পড়েছে। চালেও দামে ৫২ থেকে ৬০ টাকায় চলে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন