দেশের চলমান জ্বালানী সংকটে শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে নানমুখী আলালোচনা হচ্ছে। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ছাড়া কোনভাবেই চতুর্থ বিপ্লব সম্ভব না। আর এলএনজি আমদানি নির্ভরতা থাকলে গ্যাসের দাম সামনে চারগুণ বেড়ে যেতে পারে। কমতে থাকা গ্যাসের উৎপাদন ধরে রাখতে হলেও গ্যাসের ব্যাপক অনুসন্ধান দরকার হবে। এমন অবস্থায় আর কোন কথা না শুনে সরাসরি কয়লা উত্তলন শুরু করার তাগিদ দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পরিবেশবাদীদের একহাত নিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। জ্বালানী সংকটের সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতার শংকায়ও রয়েছেন তারা।
গতকাল মতিঝিলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তরা। ‘শিল্পখাতের টেকসই উন্নয়নে জ্বালানী নিরাপত্তা’শীর্ষক এ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস। এফবিসিসিআই সভাপতি মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে এ সভায় বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী, জ্বালানী বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অংশগ্রহণ করেন। জ্বালানীর বিভিন্ন সংকট ও তা থেকে উত্তরণের নানা পরামর্শের পাশাপাশি যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিতে জমে ওঠে সেমিনারটি। তাই সামনে জ্বালানী নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আরো ৩টি সেমিনার আয়োজন করবে বলে জানায় এফবিসিসিআই।
সভার শুরুতেই স্বাগত বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বিদ্যুৎ ছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অসম্ভব বলে জানান। জ্বালানীর ৬২ শতাংশ চাহিদা গ্যাসের মাধ্যমে মিটলেও ৪৪ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস নির্ভর। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে তৎপর হওয়ার আহ্বানের পাশাপাশি জলে-স্থলে গ্যাস অনুসন্ধানের তাগিদ দেন তিনি।
একইসময়ে এ ব্যসায়ী নেতা দীর্ঘ মেয়াদে সাশ্রয়ী হিসেবে কয়লা ভিত্তিক জ্বালানীতে যাওয়ার কথা জানান। আমেরিকা-ভারতে হলে বাংলাদেশে কেন হবে না সে প্রশ্নও রাখেন তিনি। গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান জসিম। শিল্পখাতে লোডশেডিং হলে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য ব্যাহত হতে পারে বলেও আশঙ্কা তার।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রাথমিক জ্বালানী হিসেবে গ্যাসের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তবে বর্তমানে গ্যাস থেকে ৩৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের দিকে যাওয়া হয়েছে। অথচ তা নবায়নযোগ্য জ্বালানীর দিকে যাওয়ার কথা ছিল বলে মনে করেন তিনি।কিন্ত হয়েছে তার উল্টোটা।
এদিকে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও ৫৪% বিদ্যুৎ বাসা বাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে। যেখানে শিল্পখাত ব্যবহার করছে ২৮ শতাংশ বিদ্যুৎ। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার হওয়ায় এলএনজি নির্ভরতা বেড়েছে। ফলে ২০৩০ নাগাদ মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ গ্যাস আমদানি করতে হবে। এখন প্রতি কিউবেক মিটারে ১২ টাকা খরচ হলেও তা ৪০ টাকায় পৌঁছে যেতে পারে। ফলে নতুন গ্যাসক্ষেত্র না পেলে তা বিশাল চাপ তৈরি করবে।
তাই পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপে বিদেশি ফান্ড না পেলেও নিজস্ব অর্থায়নে কয়লা মাইনিং করা যায় বলে মতামত দেন তিনি।
অন্যদিকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরকার ১১ টাকা ব্যয়ে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ পেলেও সোলার সিস্টোমে তা ৮ টাকায় করা সম্ভব। এ কথা বলার সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস আপত্তি তুলেন। পরে বেশ কয়েকজন এতো কমে সম্ভব না বলে মূখ্যসচিবের সাথে যোগ করেন। কিন্তু ড. ইজাজ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন এটা ৮ টাকায় সম্ভব। পরে ড. আহমদ কায়কাউস ওনাকে ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্র চালু করে তা প্রমাণ করতে বলেন। তখন আরো কয়েকজন গবেষক দাঁড়িয়ে ৮ টাকার চেয়ে কমে সম্ভব বলে ড.ইজাজের সাথে সুর মিলান। তুমুল বিতের্কের মধ্যে এফবিসিসিআই সভাপতি মাইক অন করে হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি শান্ত করেন।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে করে শিল্পখাতে জ্বালানী ব্যবহার ২১ শতাংশ কমানো যাবে বলেও উল্লেখ করেন বুয়েটের সাবেক এ অধ্যাপক। তিতাসের গ্যাস ৮-৯ শতাংশ চুরি হয় বলে জানান তিনি। আলোচনার শেষ পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধানের কোন বিকল্প নেই বলেন তিনি। তবে গ্যাসের দাম নিয়ে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে এমন তথ্য ব্যবসায়ীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়াবে বলে জানান বিটিএমএ সভাপতি আলী হোসেন খোকন।
প্যানেল আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানী বিশষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাস কূপ খনন করে গ্যাস পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের সফলতা রেট থেকে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বে ৫টি কূপ খনন করে একটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে ৩টি কূপের মধ্যে ২টিতে গ্যাস পাওয়া যায়। অনেক দেশে ১০টি কূপ খনন করলে একটিতে গ্যাস পায়। তবুও বিশ্বের সবচেয়ে কম খননকারী দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ।
তিনি তথ্য দিয়ে দেখান, যেখাতে ভারতের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের ত্রিপুরা রাজ্যে ১১৭টি কূপ খনন করা হয়েছে। সেখানে তার চেয়ে ১০ গুণ বড় বাংলাদেশে খনন করা হয়েছে ১০০টি কূপ। মিয়ানমার সাগর থেকে গ্যাস উত্তলন করে তা চীনে রপ্তানী করলেও আমাদের সাগরে কিছুই করা হয়নি বলেও জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ড ও কানাডার গবেষণায় দেশে ৪২ টিসিএফ গ্যাস মজুদের কথা বলা হলেও তা নিয়ে কিছুই করা হয়নি।
দেশের গ্যাসের ৫০ শতাংশ বিবিয়নার মাধ্যমে উপাদন হয়। ৫/৬ বছর পর এটার উৎপাদন কমে যাবে। তখন
বিবিয়ানার ২৬টি কূপের মধ্যে ১৫টি কূপও যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে দেশ অন্ধকারে চলে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ জ্বালানী বিশেষজ্ঞ।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্যালেন আলোচক হিসেবে আলী হোসেন খোকন বলেন, মাত্র ১০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করে শিল্পখাতের জিডিপিতে অবদান ২৯ শতাংশ। একদিকে উন্নয়নশীল দেশ বলা হলেও অন্যদিকে গ্যাস না দিলে বৈদিশীক মুদ্রা কোথায় পাবে, সে প্রশ্ন রাখেন তিনি। গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় গণশুণানীতে কোন উত্তর পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করে এমন প্রহসনের গণশুনানী না আয়োজন করার আহ্বান জনান তিনি। এসময় মুর্হুমুহু তালি দিয়ে তার বক্তব্যকে সমর্থন জানান ব্যবসায়ীরা।
তিতাস ২ হাজার এমএমসিএফ গ্যাসের কোন হদিস দিতে পারে না বলেও অভিযোগ তার। এটা থাকলে আরো ৫ বিলিয়ন ডলার আর্নিং করা যেত বলেও মনে করেন এ ব্যবসায়ী। ভারতে বিদ্যুৎ খাতে ৫১ শতাংশ কয়লা ব্যবহার করলেও আমরা কেন কয়েল পাওয়ারে যাচ্ছি না, সে প্রশ্নও রাখের তিনি। গ্যাস আমদানিতে ৫-৭ হাজার কোটি টাকার জরুরি ফান্ড রাখারও দাবি জানান তিনি। গ্রামে কোন গ্যাস লাইন না দিয়ে এলপিজি দিতে বলেন। কারণ পাইপ লাইন থাকলে গ্যাস লাইন চুরি হবেই বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী।
মেট্রোপলিটন চেম্বারের পক্ষ থেকে সাইফুল ইসলামও কয়লা উত্তলনে নজর দিতে বলেন। আমরা মাত্র দশমিক ৪ শতাংশ কার্বণ নিঃসরণ করি তাই কয়লা কোন সমস্যা না মনে করেন তিনি।
এনার্জিপ্যাকের চেয়ারম্যান হুমায়ুন রশিদ বলেন, জ্বালানী নিরাপত্তা ছাড়া আমাদের ভবিষ্যৎ খুব ভালো না। এনার্জি ইফিসিয়েন্সি করতে নতুন বিল্ডিং কোড করার আহ্বান জানান তিনি।
সাংবাদিক মোল্লা আমজাত মনে করেন অর্ধসত্য কথায় নীতিনির্ধারকরা বিভ্রান্ত হয়েছেন। কয়লার দিকে তাকানো ছাড়া কোন উপায় নেই বলেও মত তার।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে মেক্সগ্রুপের পক্ষ থেকে ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর বলেন, সুপার কুইস এনার্জি সলিউশন নাম দিয়ে কয়েল মাইনিং শুরু করেন। বিজ্ঞলোকের কথা অনেক শোনা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম মনে করেন ৭০ বছর কয়েল দিয়ে জ্বালানী সমস্যার সমাধান করা যাবে।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীন বৈশ্বিক পরিস্থিতির সাথে রাজনৈতিক অবস্থা যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। রাজনৈতিক অবস্থা যেন খারাপ না হয় সেই প্রত্যাশা জানান তিনি। এদিকে সিরামিক শিল্পের মেশিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানান আজিজুল ইসলাম। ৩ মাস ধরে ১২ ঘন্টা গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। যদিও সিরামিক মেশিন ২৪ ঘন্টা চালু রাখতে হয়। নিওয়্যার সেক্টরের মনসুর আহমেদ বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে খুব সংকটে দিন কাটছে। কারখানা বন্ধ রাখলে লক্ষ্য বাস্তবায়ন হবে না।
দিপঙ্কর চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, ৫০ শতাংশ ছাদে সোলার ব্যবস্থা করলেও ১ বছরে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
সব আলোচনা শোনার পর বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, আপনারা সবাই কয়লার কথা বলছেন। তবে আজকের বাজার দর হিসেব করলেও কয়লা কিন্তু সাশ্রয়ী নয়। তবে শিল্পখাতে লোডশেডিং সামন্বয় করা হবে বলেও জানান তিনি। সব জাগায় কারখানা হয়েছে তাই হয়তো সমন্বয়ের অভাবে হচ্ছে মনে করেন তিনি। জার্মানি আবার কয়েলে যাচ্ছে উল্লেখ করে পরিবেশবাদীরা ইউক্রেনে বোমা হামলা নিয়ে চুপ থাকেন কেন, সে প্রশ্ন তুলেন তিনি।
সবশেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী বলেন, কৃষি ও শিল্প খাতকে বাঁচিয়ে রেখে বাকি সেক্টরে বেল টাইট করা সরকারের নীতি। ভূ-রাজনৈতিক কারণে দেশ গ্যাসে ভাসছে বলে তা রপ্তানীর কথা বলা হয়েছিল। এখন অনেক জ্বালানী রাজনীতি চলছে তা বুঝতে হবে বলেও জোর দেন তিনি।
আনন্দবাজার/শহক