স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে ১৯৭০-এর দশকে দেশের শিল্পায়নের দিকে যাত্রার ক্ষেত্রে বৃহৎশিল্প হিসেবে চিনিকলগুলো অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলো। তবে সময়ের ব্যবধানে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে তাল মিলাতে না পারায় লোকসানে চলে চায় চিনিশিল্প। এতে হুমকিতে পড়ে এ খাতের সঙ্গে জড়িত হাজারো শ্রমিকের রুটি-রুজি।
পুরনো যন্ত্রপাতির মিলগুলোকে আধুনিকায়ন করা হলে চিনি উৎপাদন বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই লোকসানে থাকা চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক করার পরিকল্পনা নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। এরই অংশ চিনিকল এলাকায় মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি)-এর আওতায় ‘১৪টি চিনিকলে বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি স্থাপনের প্রকল্প নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সালের মে মাসে ৮৫ কোটি ১০ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন পায়। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নের এ প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে ২০২২ সালের বেশিরভাগ সময় পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি এখনো শেষ করা যায়নি। তিন দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে এখন ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
এর আগে প্রথম দফায় ব্যয় অপরিবর্তীত রেখে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়। তবে, বর্ধিত এসময়েও কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে চলতি অর্থবছরের প্রথম একনেক সভায় মেয়াদ বাড়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।
এদিকে প্রথমে ১৪টি চিনিকলে ইটিপি স্থাপন করার কথা থাকলেও সরকার ৬টি চিনিকলের (পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, পানা ও কুষ্টিয়া) আখ মাড়াই কার্যক্রম স্থগিতের সিদ্ধন্ত নেয়। ফলে স্থগিত এসব চিনিকলে ইটিপি স্থাপন করা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি ৫টি চিলিকলে ইটিপি স্থাপন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই প্রকল্প ব্যয় ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়।
প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবের বিষয়ে গত ডিসেম্বরে আলোচনা হয় পরিকল্পনা কমিশনে। কমিশনের মূল্যায়ন কমিটির সভায় আরও ২টি (রাজশাহী ও ফরিদপুর) চিনিকলে ইটিপি স্থাপনের প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয় শিল্প মন্ত্রণালয়কে। পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশের আলোকে প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে ২টি চিনিকল অন্তর্ভূক্ত করে। বাকি ৩টিতে আংশিক কাজ অসমাপ্ত রেখে ১১ চিনিকলে ইটিপি স্থাপন করার বিষয়ে প্রকল্প পরিকল্পনা সংশোধন করা হয়।
পরবর্তীতে প্রথম সংশোধীত প্রস্তাবের ওপর গত এপ্রিলে মূল্যায়ন কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক হয় পরিকল্পনা কমিশনে। এ বৈঠকে প্রকল্প ব্যয় ৮৫ কোটি থেকে কমিয়ে ৮১ কোটি ৮৪ লাখ করে প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ফলে প্রতিটি ইটিপি স্থাপনের ব্যয় পড়বে ৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা করে। সর্বশেষে মেয়াদ বাড়িয়ে ও ব্যয় কমিয়ে প্রকল্পটি ২১ জুন অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে এ প্রকল্পে আরে কোনো মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হবে না বলেও উল্লেখ করে দেয় পরিকল্পনা কমিশন। তাও নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
চিনিকলের অবস্থা
১৯৬৫ সালে পঞ্চগড়ের ধাক্কামারা এলাকায় ১৯৮ দশমিক ৪৬ একর জমিতে পঞ্চগড় চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরীক্ষামূলকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে চিনিকলটি জাতীয়করণ করা হয়। কলটির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ১০ হাজার মেট্রিক টন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চিনিকলটিতে গড়ে ৮ হাজার ৫৩৬ টন চিনি উৎপাদিত হতো। এতে লাভেই ছিল প্রতিষ্ঠানটি। সবশেষ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা মুনাফা আসে এখান থেকে।
কিন্তু চিনির লাভ আর বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০০৬ সাল থেকে ধারাবাহিক লোকসান পর্ব চলতে থাকে। এভাবে ১৫ বছর ধরে টানা লোকসান করে যাচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি। একই অবস্থা অন্য চিনিকলগুলোর। দেড় দশকে আখ চাষ অনেক কমেছে। চিনি উৎপাদনও কমেছে। এ ছাড়া কলের যন্ত্রপাতি পুরোনো। ফলে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উৎপাদন কমেছে। উল্টো বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ। এতে চিনিকলে বিকল্প আয়ের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বহুমুখী প্রকল্প নেয়ার পরামর্শও এসেছে নানা সময়ে।
২০২০ সালের শেষ দিকে দেশের ১৫টি রাষ্ট্রীয় চিনিকলের মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রীয় চিনিকল বন্ধের ঘোষণা আসে। ২০২০-এর মাড়াই মৌসুমের পাবনা চিনিকল, কুষ্টিয়া চিনিকল, রংপুর চিনিকল, পঞ্চগড় চিনিকল, শ্যামপুর চিনিকল, সেতাবগঞ্জ চিনিকলের আখ মাড়াই বন্ধ করে উৎপাদিত চিনি পার্শ্ববর্তী চিনিকলগুলোয় মাড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলে শুধুমাত্র আখের সঙ্গে জড়িত কৃষক-শ্রমিকেরাই শুধু বিপদগ্রস্ত হন নাই। ব্যাগাস ও ঝোলাগুড় কেনা-বেচার ব্যবসা করে অনেকের সংসার চলে। আখের বর্জ্য থেকে প্রেসমাড ব্যবহৃত হয় আশেপাশের কৃষি কাজে সার হিসেবে। মিল এলাকা ঘিরে চলে ভাতের হোটেল, মুদি দোকান, বাজার, পরিবহন ব্যবসা, বিদ্যালয়, কলেজ, মসজিদ, আবাসিক এলাকা এবং ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ চিনিকল নির্ভর একটা জনপদের পুরো অর্থনীতি। চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়ায় ইতিমধ্যে প্রান্তিক এ মানুষেরা হুমকির মুখেও পড়েছেন।
তাছাড়া চিনিকলগুলো বন্ধ রাখার পর দেশের চিনির উৎপাদন পরপর দুই বছর ৪১ শতাংশ ও ৫৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অথচ বৈশ্বিক এ অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেও এ সময়ে ভারতে ৪০ ও ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ ভারতে চিনিশিল্পের বিকাশ ঘটলেও দেশের চিনিশিল্প মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। তাই আধুনিকায়নের মাধ্যমে ফের উৎপাদনে আসার চেষ্টা ও দাবি জোড়ালো হচ্ছে।
আনন্দবাজার/শহক