মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বর্ষার খরায় বিপদে কৃষি

বর্ষার খরায় বিপদে কৃষি

ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা মামুনুর রশিদ। শিক্ষকতার অবকাশে করেন কৃষি কাজ। চলতি মৌসুমে বোরো ধান কেটে কয়েক কাঠায় আউশ লাগিয়েছেন। আশায় ছিলেন বর্ষায় ভালো ফলন হবে, উৎপাদিত বাড়তি ধানে সংসারের চাহিদা মেটাবেন। তবে বর্ষার ভরা মৌসুমের প্রচণ্ড খরা ও তাপদাহ তার স্বপ্ন বিবর্ণ করে দিয়েছে। ধানের গাছ শুকিয়ে গেছে, পুড়েও গেছে। তার মাথায় এখন হাত পড়েছে। বৃষ্টির আশায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কখন মেঘ করবে, মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু বৃষ্টি আর নামে না।

একই গ্রামের আরেক চাষি ওসমান গনিও আউশ লাগিয়েছেন। তবে পানি সেচের জন্য তারা শ্যালো মেশিন রয়েছে। তবে তিনি আশায় রয়েছেন ভরা বর্ষার বৃষ্টির। আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এলেই ভাবেন বৃষ্টি হবে। তবে বৃষ্টি আর হয় না। ধানে গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। পুড়েও যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় শ্যালো মেশিন চালিয়ে সেচও দিতে পারছেন না। ফলে পুড়ে যাচ্ছে গাছ।

একই রকম সংকটে পড়েছেন ত্রিশাল সদরের আরেক চাষি আব্দুর রশিদ। তার কয়েক কাঠায় লাগানো আমনের বীজতলা তীব্র তাপে পুড়তে শুরু করেছে। অনেক চারা মারা যাচ্ছে পানির অভাবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাষি রশিদ বলেন, শাওন (শ্রাবণ) মাসে অনেক বিস্টি অয় (বৃষ্টি হয়)। কিন্তু এইবার তার উল্টা। আমরা তো জালা (ধানের চারা) ফালাইয়া খরানে মইরা (ফেলে খরায় মরে) গেলাম। তার ধানের জমির পাশেই আরেক চাষি রইস উদ্দীনের রোদে পোড়া ধান গরু ছাগলে খেতে শুরু করেছে। রইস হতাশ হয়ে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন।

দেশের উত্তর জনপদের চাষিরাও পড়েছেন বিপাকে। দিনাজপুরের হিলির ছাতনি গ্রামের আনসার আলী বৃষ্টি না থাকায় আমন লাগাতে পারেননি। বেশ কিছুদিন ধরে হিলিতে বৃষ্টির দেখা নেই। পানির অভাবে বীজতলায় চারা মরে যাচ্ছে। আনসারি আলী বলেন, খুব বিপদে আছি। একই গ্রামের কৃষক তসলিম বীজ থেকে শুরু করে জমিতে চারা রোপণের জন্য সবকিছু প্রস্তুত করেছেন। শুধু বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এখন পর্যন্ত এক বিঘা জমিতেও চারা লাগাতে পারেননি। তিনি বলেন, এলাকায় শ্যালোমেশিনের পরিস্থিতি নেই। গভীর নলকূপ আছে কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। তারা যদি চালু করতো তাহলে চারা রোপণ করতে পারতাম।

আরও পড়ুনঃ  খেয়াল-খুশি মতো এলপি গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা

মূলত ত্রিশালের মামুন রশিদ, ওসমান গনি কিংবা রইস উদ্দিন কিংবা হিলির আনসার আলী, তসলিমই নন, গোটা দেশেই চাষিরাই পড়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়। ভরা মৌসুমে তীব্র খরার কারণে কৃষিতে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়েছে পরিবেশ। চাষিসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে উদ্ভট এক আবহাওয়া বিরাজ করছে। ভরা বর্ষাতে আকাশে ঘন মেঘের দেখা মিলছে না। বর্ষণের বদলে সারাদেশেই চলছে তাপপ্রবাহ। বিচ্ছিন্নভাবে হালকা বৃষ্টি হওয়াতে ভ্যাপসা গরম বেড়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্ষাতে গ্রীষ্মের মতোই তাপমাত্রার পারদ লাফিয়ে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠছে। যে তাপপ্রবাহ বিস্তৃত হয়েছে দেশের ১৩টি এলাকায়। গত শনিবার উত্তরের জেলা নীলফামারীর সৈয়দপুরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। একই দিনে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৫ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ছিল চলতি জুলাইয়ে সর্বোচ্চ। অবশ্য চলতি মৌসুমের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গত ১৫ এপ্রিল। যেদিন পারদ উঠে গিয়েছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

শুধু চলতি মৌসুমেই নয়, বিগত কয়েক বছর ধরেই অস্বাভাবিক চিত্র দেখা যাচ্ছে আবহাওয়ায়। কখনও অতিবৃষ্টি, কখনও অনাবৃষ্টিতে ফসলহানি হচ্ছে। পাশপাশি বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে কৃষিখাতের। উত্তরের চাষিরা বলছেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় গত বছরও আমন মৌসুমে বিপাকে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের চাষিদের দেয়া তথ্যমতে, পর্যন্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে বিঘাপ্রতি বাড়তি যেমন দেড় দুই হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে, একইভাবে উৎপাদনও কমে আসছে।

আরও পড়ুনঃ  বৃহস্পতিবার থেকে দেশে ফিরবেন হাজিরা

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা তাদের অভিজ্ঞতার তথ্য তুলে ধরে বলেন, বিগত ২০১৪ ও ২০২১ সালের জুলাইয়েও তাপপ্রবাহের ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেই দুই বছরের চেয়ে এবার দীর্ঘ এবং বেশি এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে তাপদাহ। তারা আরও বলছেন, চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে হবে। কারণ সহসাই আবহাওয়ার বিরূপ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে যে তাপদাহের বিপর্যয়, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক সংকট। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষ রোপন করতে হবে। ফলদ ও ফুলেল ও পশু-পাখির উপযোগী বৃক্ষরোপন অপরিহার্য। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান অবশ্য এ ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।

আবহাওয়াবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থাগুলো বলছে, বিশ্বের অর্ধেকের বেশি এলাকাজুড়ে এখন তীব্র দাবদাহ বইছে। ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াজুড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। তাপদাহ এভাবে চলমান থাকলে কৃষিখাতে বিপর্যয় নেমে আসবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্রপস উইং এর পরিচালক জাহিদুল আমিন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আউশ মৌসুমে বেশিরভাগ মানুষ পাট চাষ করেন। পানির অভাবে অনেকেই তা জাগ দিতে পারছে না। এটি কৃষি অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, পানি না পেলে আউশের থোড় ধানের ক্ষতি হবে। তা ছাড়া বৃষ্টিপাত না হলে সেচ বাবদ খরচ বেড়ে যাবে। এতে কৃষককে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে।

তবে বেশি পানির আবাদ বোরোতে চাপ কমানোর পাশাপাশি সেচের সুব্যবস্থা কম, এমন এলাকায় আউশ ধানের বিভিন্ন জাত জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে গত কয়েক বছর ভর্তুকি ও প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হলেও বাড়ছে না আউশের আবাদ ও উৎপাদন। এক বছরের ব্যবধানে আউশের আবাদ কমেছে ১ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর বা ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। এছাড়া উৎপাদন কমেছে প্রায় ৩ লাখ টন বা ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

আরও পড়ুনঃ  ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক: জাতিসংঘ

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ডিন অধ্যাপক মো. আব্দুল লতিফ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমার বাড়ি পাবনা জেলার সুজানগরে। সেখানে দেখেছি প্রচুর পাট চাষ হলেও জাগ দেয়ার পানি নেই। কৃষকরা পাট জাগ দিতে পারছে না। বাদাম শুকিয়ে নষ্ট হচ্ছে। এতে ২০ শতাংশ উৎপাদন কমে যাবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর-বিবিএস আউশ ফসলের প্রাক্কলিত হিসাব ২০২১-২২ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৮৪ হাজার ৭১০ টন আউশের উৎপাদন হলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৩০ লাখ ৮৫৭ টনে নেমে আসে। অর্থাৎ উৎপাদন কমেছে প্রায় ২ লাখ ৮৪ হাজার টন। ফলে এক অর্থবছরের ব্যবধানে উৎপাদন কমেছে প্রায় ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে আউশের আবাদ হয়েছিল ১৩ লাখ ৪ হাজার ৯৯৮ হেক্টর জমিতে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে আউশের আবাদ হয়েছে মাত্র ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে। ফলে এক অর্থবছরের ব্যবধানে আউশের আবাদ কমেছে প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টর বা প্রায় ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ।

তথ্যমতে, ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে আউশের উৎপাদন ছিল প্রায় ২৩ লাখ ৪১ হাজার টন। পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ আবাদ ছিল ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে। সে সময়ে আবাদ ছিল ৩৪ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। তবে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরে। সে সময়ে উৎপাদন ছিল ৩২ লাখ ৮৭ হাজার টন। যদিও আবাদ হয়েছিল ৩২ লাখ ৩৪ হাজার একর। পরবর্তী এক দশক উৎপাদন ৩০ লাখ টনের ঘরে ছিল। গত অর্ধ যুগের বেশি সময় ধরেই আউশ আবাদে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন